ছােটগল্প কাকে বলে কত প্রকার ও কি ছােটগল্প বিস্তারিত

ছােটগল্প কাকে বলে কত প্রকার ও কি ছােটগল্প বিস্তারিত


ছােটগল্প কাকে বলে,ছােটগল্প,



ছোটগল্প সম্পর্কে বাংলা স্বার্থক ছোটগল্পাকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন


" ছোট প্রাণ ছোট ব্যথা    ছোট ছোট দুঃখকথা
       নিতান্তই সহজ সরল,
সহস্র বিস্মৃতি রাশি   প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
        তারি দু'চারিটি অশ্রুজল।
নাহি বর্ণনার ছটা   ঘটনার ঘনঘটা
        নাহি তত্ত্ব, নাহি উপদেশ
অন্তরে অতৃপ্তি রবে,   সাঙ্গ করি মনে হবে
        শেষ হয়ে হইল না শেষ "।



অর্থাৎ,
ছোটগল্প হচ্ছে গদ্য রীতিতে রচিত সাহিত্যের সর্বকনিষ্ঠ শাখা, যেখানেয একমুখীন ছােট আকারের কাহিনীতে গভীর বেদনার ছবি ও দু ’ চারটে ঘটনার ইঙ্গিতধর্মী বর্ণনায় তত্ত্ব উপদেশহীনভাবে অতৃপ্ত অন্তরকে বিমূঢ় করে আকস্মিকতায় সমাপ্ত  করা হয় , তাকেই ছােটগল্প বলে ।


 ছােটগল্প আকারে ছােট , ভাবে একক , বচনে পরিমিত কিন্ত ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ । আকারে ছােট বলে বহু ঘটনা ও পাত্র - পাত্রীর সমাবেশ এখানে ঘটে না । অপ্রয়োজনীয় কথা , অনাবশ্যক চরিত্র ও ঘটনা  নিষ্ঠুরভাবে বর্জন করে একটা রসঘন নিটোল কাহিনী ছােটগল্পে প্রকাশ করা হয় ।


ছোটগল্পের সূচনা ও সমাপ্তি নাটকীয় হয় । ক্ষুদ্র কলেবরের মধ্যে নিগুঢ় সত্যের ব্যঞ্জনাই এর সার্থকতা । পরিমিত বর্ণনায় পরিবেশ ও আবহাওয়া তুলে আনা , শব্দ চয়ন , উপমা - অলঙ্কার প্রয়ােগ , ভাব ও বিষয়ানুসারে ভাষা ব্যবহৃত হয় । ছােটগল্প মানব জীবনের গভীরতর রহস্যভেদ করে না । জীবনের অবিরাম স্রোতে ক্ষণপ্রাণ ও ক্ষণ বিলীয়মান যে তরঙ্গ উঠছে , পড়ছে , ভাঙছে লেখক তাকেই রসঘন করে তুলবেন ।



একটি নির্দিষ্ট ভাবের কার্যকারণ , সম্মত বিন্যাস চরিত্রের কর্ম ও চিন্তার মধ্য দিয়ে ছোটগল্পে রূপলাভ করে । মূলত আয়তন বা আকৃতির ছােট বড় দিয়ে নয় , বিষয়ের মধ্যে বড় কোনাে ব্যঞ্জনা এবং সামগ্রিকতা সৃষ্টি হল কিনা সেটাই সার্থক ছােটগল্পের মূখ্য ভূমিকা।



 ছােটগল্পে ক্ষণকালীন জীবনের মধ্যেও সৃষ্টি হয় চিরকালীন ব্যঞ্জনা । মানুষের বহির্জীবন বা অন্তজীবনের যে কোনাে ক্ষেত্র থেকে ছােটগল্পের উপকরণ আহৃত হতে পারে । নির্মম কঠিন বাস্তব জগৎ , মানবমনের জটিল রহস্য , সংকট ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বহমান জীবনের যে কোনাে প্রসঙ্গকে গল্পের উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করা চলে ।


ছােটগল্পের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য পাঠককে পরিপূর্ণ তৃপ্তি বা আনন্দদান । ছােটগল্প এক মানবিক শিল্পরূপ। শিল্পীর জীবনবিন্যাসের ব্যাখ্যা এবং অভিজ্ঞতার ঐক্যবদ্ধ সংহত রূপ । ঘটনাংশ , চরিত্র , পরিবেশ , ঘটনান্তর্গত ভাবসূত্র - এগুলাের সমন্বয়ে ছােটগল্প এক ঐক্যময় শিল্পরূপ ধারণ করে।



ছােটগল্পের শ্রেণিবিন্যাস বা ছোট গল্পের প্রকারভেদ


১) প্রেম - বিষয়ক ছােটগল্পঃ-


যে ছােটগল্পের মূল উপজীব্য বিষয় প্রেম , অর্থাৎ প্রেমের প্রতিবেশ , পরিবেশ এবং প্রেমের বিচিত্র অবস্থা বর্ণনা। যার মাধ্যমে প্রেমের একটিমাত্র রস পরিণাম মুখ্য হয়ে উঠে তাকে প্রেম - বিষয়ক ছােটগল্প বলে ।
যেমন;-
 বঙ্কিমচন্দ্রের "রাধারাণী",
 রবীন্দ্রনাথের "একরাত্রি " , " নষ্টনীড় " ,
প্রেমেন্দ্র মিত্রের "ভশেষ " প্রভুতি প্রেম - বিষয়ক ছােটগল্পের উদাহরণ ।


২) সামাজিক ছােটগল্পঃ-


সমাজের বিশেষ কোনাে চালচিত্র ছােটগল্পের বিষয় করে উক্ত সামাজিক বিষয় গল্পে রসসিক্ত করে তুললে তাকে সামাজিক ছােটগল্প বলে । এ ধরনের ছােটগল্পে সমাজে বসবাসকারী মানুষের বিশেষ কোনাে আচার - আচরণ , রাতিনীতি , মানসিক অনুভূতি , সামাজিক শশাষণ , সমাজে বসবাসরত মানুষের দারিদ্র্য , হৃদয়ানুভূতি বা মানসিক প্রবৃত্তি ইত্যাদি কোনাে না কোনাে বিষয় গল্পের উপজীব্য হয় এবং তাকে গল্পে রসঘন করে তুললে তা সামাজিক ছােটগল্পের মর্যাদা পায়।


এ সামাজিক গল্পে সমাজের বিচিত্র প্রসঙ্গের উপস্থাপন ঘটে । বিশেষণের দক্ষতা ও গভীরতায় রাজনীতির তত্ত্ব , আদর্শ ও ঘটনার প্রতিফলন ঘটে সামাজিক ছােটগল্পে ।

যেমন,
 রবীন্দ্রনাথের " পােস্টমাস্টার " , " হৈমন্তী " ,
শরৎচন্দ্রের " মহেশ " , "শৈলজানলে " কয়লাকুঠি " ইত্যাদি সামাজিক ছোট গল্প।


৩) প্রকৃতি ও মানুষ - বিষয়ক ছােটগল্প

 শিল্প সাহিত্যে বর্ণিত মানব চরিত্র কোনাে না কোনাে প্রকৃতির মধ্যেই চলমানতা পায় । কিন্তু যে গল্পে মানব চরিত্র প্রকৃতির পটভূমিতেই অঙ্কিত হয় , অর্থাৎ প্রকৃতি মানব চরিত্রের ভিত্তিভূমি হিসেবে মানব চরিত্রের সুখ - দুঃখের পশ্চাৎপট রূপে বিবেচিত হয় ; কখনাে বা প্রকৃতি বিশেষ চরিত্রের মর্যাদা পায় তাকে প্রকৃতি ও মানুষ - বিষয়ক ছোটগল্প বলে ।

রবীন্দ্রনাথের "তারাপদ " , " অতিথি " ,
মনােজ বসুর " বনমর্মর" প্রভৃতি প্রকৃতি ও মানব বিষয়ক ছোটগল্প।




৪)হাস্যরসাত্মক ছােটগল্প


যে ছােটগল্পের কাহিনী ও চরিত্রের সক্রিয়তার মধ্য দিয়ে হাস্যরস সৃষ্টি হয় এবং যে গল্পে কাহিনী বা চরিত্রের তুলনায় হাস্যরস মধুরতার স্পর্শই প্রধান হয়ে দেখা দেয় তাকে হাস্যরসাত্মক ছােটগল্প বলে । এ ধরনের গল্প কেবল বিশুদ্ধ হাসিরই সৃষ্টি করে না , কখনাে কখনাে গভীর ইঙ্গিতময় বক্তব্যও প্রদান করে ।

যেমন,
 রবীন্দ্রনাথের "অধ্যাপক ", রাজশেখর বসুর "খােকার কাণ্ড", জগদীশ গুপ্তের " জ্যাঠানন্দ " প্রভুতি হাস্যরসাত্মক ছােটগল্পের উদাহরণ ।



৫ . অতিপ্রাকৃত ছােটগল্প


 আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অতি সহজ কথা বা কাজ কর্মের মধ্যে অতীন্দ্রিয় অতিপ্রাকৃত জগতের মায়াজাল বিস্তৃত করে আকস্মিক একটা সাময়িক মনােবিকার ঘটিয়ে তাকেই অবলম্বন করে বিশেষ কলাকৌশলে রহস্য নিবিড় বর্ণনাভঙ্গিতে অপরূপ কল্পনার ঐশ্বর্য ছড়িয়ে সমস্ত আখ্যানটি রসে রহস্যে আবৃত করে ভয়ার্ত ও কৌতূহলী করে তােলে যে ছােটগল্পে , তাকেই অতিপ্রাকৃত ছােটগল্প বলে ।


 অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক রহস্য এসব গল্পকে আচ্ছন্ন করে রাখে অথবা তারই মৃদু শিহরণে এসব গল্প রহস্য মধুর বা ভয়াবহ রূপকান্তি লাভ করে ।


যেমন,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের " ক্ষুধিত পাষাণ " , " নিশীথে " , " সম্পত্তি সমর্পণ" অচিন্ত্য সেনের " ছায়া " বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের "অভিশপ্ত " , অমলাদেবীর "মহামৃত্যু " প্রভৃতি । অতিপ্রাকৃত ছােটগল্পের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।



 ৬) উদ্ভট গল্প


যে সমস্ত গল্পে অসম্ভব বা অবাস্তব কাহিনী লেখকের বর্ণনা ও শিল্পগুণে বাস্তবতা অতিক্রান্ত রূপ পরিগ্রহ করে তাকে উদ্ভট গল্প বলে ।

যেমন,
 বিভূতিভূষণের "নারায়ণী সেনা " কেদার বন্দ্যোপাধ্যায়ের "ভগবতীর পলায়ন " উদ্ভট গল্পের উদাহরণ । ।



৭) সাংকেতিক বা প্রতীকধর্মী ছােটগল্প


যে সমস্ত গল্পের কাহিনী , পাত্র - পাত্রীর কথােপকথন ও প্রতিবেশ - পরিবেশের অন্তরালে অন্য কোনাে গৃঢ় তাৎপর্যকে ব্যঞ্জিত করে অর্থাৎ আপাত কাহিনীর বাহ্যিক খােলসের অভ্যন্তরে অন্য সত্য উচ্চারিত হয় । এবং প্রতীক বা সংকেতের ব্যঞ্জনাই গল্পের মুখ্য আবেদন হয়ে ওঠে, তাকে প্রতীকধর্মী গল্প বলে ।

যেমন,
রবীন্দ্রনাথের "তাসের দেশ " , " গুপ্ত ধন " ,। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের "মরু ও সঙখ " এ ধরনের গল্পের উদাহরণ ।



 ৮) ঐতিহাসিক ছোটগল্পঃ-


 ছােটগল্প যেহেতু আয়তনে সংক্ষিপ্ত ফলে ইতিহাসের কোনাে ঘটনাকে সে অর্থে সত্যনিষ্ঠ করে তােলার সুযোগ থাকেনা । তাই ইতিহাসের সাথে বাস্তবমুখী কল্পনা মিশ্রিত করে যে ছােটগল্প রচিত হয় তাকে ঐতিহাসিক ছােটগল্প বলে ।

যেমন,
রবীন্দ্রনাথের "দালিয়া " ,।
 শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের " মৃৎপ্রদীপ " ,।
বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের "প্রত্নতত্ত্ব" ইত্যাদি ঐতিহাসিক ছোটগল্প হিসেবে উদাহরণ দেওয়া যায়।




৯)  বৈজ্ঞানিক ছোটগল্প


ছােটগল্পের গঠনশৈলী রক্ষা করে বিজ্ঞানের কোনাে আবিষ্কার অথবা কোনাে বিষয়কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রাধান্যসহযােগে নির্মাণ করলে তাকে বৈজ্ঞানিক গল্প বলে।

উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়,

প্রেমেন্দ্র মিত্রের " শয়তানের দ্বীপ " , সুবােধ ঘােষের "শক থেরাপী " , " সুন্দরং " , " গােত্রান্তর"প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক ছােটগল্পের উদাহরণ ।





১০) গার্হস্থ্য ছােটগল্প


কোনাে পরিবারের সদস্যদের জীবনাচরণ , প্রাপ্তি , প্রত্যাশা , সুখ দুঃখ বা পারিবারিক কোনাে বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত ছােটগল্পকে গার্হস্থ্য ছােটগল্প বলে ।

সাধারণত এ ধরনের গল্পে বিষয়বস্তু সমাজ নয় বরং সমাজ অন্তর্গত কোনাে পরিবার । পরিবার মূলে রেখেই এ ধরনের গল্প গড়ে ওঠে এবং পরিণতি পায় ।


যেমন,
রবীন্দ্রনাথের "মধ্যবর্তিনী " "বনফুলের  "তিলােত্তমা ",
 বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের " ঠেলাগাড়ি",
 রামপদ মুখােপাধ্যায়ের "সুব্রতর বিবাহ " ইত্যাদি গার্হস্থ্য ছােটগল্পের উদাহরণ।



১১) মনস্তাত্ত্বিক ছোটগল্প


যে গল্পে কাহিনী বা চরিত্র প্রধান নয় , বরং যে গল্পে নরনারীর মনের চোরাগলি হাতড়ে লেখক মনের কথা তুলে আনেন অর্থাৎ মনস্তাত্ত্বিক বােধাবােধ ছেকে তুলে তাকেই বিভিন্ন আলােকে বিশ্লেষণ করে গল্প রসঘন করে তােলা হয় তাকে মনস্তাত্ত্বিক ছােটগল্প বলে । মানবমনের রহস্যময় দিকের বিশ্লেষণ এ জাতীয় গল্পে বিধৃত হয় ।

যেমন - রবীন্দ্রনাথের " পোস্টমাস্টার",
শরৎচন্দ্রের "রামের সুমতি " ,
 নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের "টোপ " উল্লেখযােগ্য ।


১২) বাস্তবনিষ্ঠ ছােটগল্প


 ভাব ও কল্পনা পরিহার করে জীবনের রূঢ় বাস্তবতাকে গল্পের বিষয়বস্তু করে জীবনকে বাস্তবতার নিরিখে যেসব গল্পে তুলে আনা হয় তাকে বাস্তবনিষ্ঠ ছােটগল্প বলে ।

যেমন,
 প্রবােধ সান্ন্যালের " অঙ্গার " ,
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের " প্রাগৈতিহাসিক " ,
 অচিন্ত্য সেনের "বস্ত্র" প্রভৃতি বাংলা ছােটগল্পের আঙিনায় বাস্তবনিষ্ঠ ছােটগল্পের দৃষ্টান্ত ।


১৩)  ডিটেকটিভ ছােটগল্প


যে সমস্ত গল্পের মূল বিষয় কোনাে হত্যা খুন এবং পলি তার সূক্ষ্ম বুদ্ধি দিয়ে সেই হত্যার মূল রহস্য অনুসন্ধান করে তাকেই ডিটেকটিভ বলে । এ ধরনের গল্পের মৃত্যুর কারণ পাঠক যা ধারণা করে লেখকের সূক্ষ্ম  যোগ্যতায় শেষ পর্যন্ত পাঠকের চিন্তার অতিরিক্ত কোনাে হত্যাকারীকে নির্দেশ করে দেয় । পাঠক একাধারে বিস্মিত বিমুগ্ধ হয় এবং তৃপ্তি পায় ।

বাংলা সাহিত্যে পাঁচক সুরেন্দ্র মােহন ভট্টাচার্য প্রমুখ ডিটেকটিভ ছােটগল্পের সফল রচয়িতা ।


পাঠকের কাছে মতামত চাচ্ছি।
লেখা কেমন হয়েছে বা কেমন হলে ভালো হত। আপনারা পরামর্শ দিলে উতসাহ পাব।


কেউ যদি কোনো বিষয়ে আমাদের ব্লগে লেখা লেখি করতে চান তবে আমাদেত সাথে যোগাযোগ করুন। আপনাদের লেখার জন্য আপনাদের সম্মানিত করা হবে। আজকের মত এখানেই বিদায় নিচ্ছি। দেখা হবে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে।


লেখা ভালো লাগলে অবশ্যই বন্ধুদের সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইল।

কোন মন্তব্য নেই

enot-poloskun থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.