রোমান্টিসিজম কি : রোমান্টিসিজমের উৎপত্তি,সংজ্ঞা এবং এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা কর।

রোমান্টিসিজম কি : রোমান্টিসিজমের উৎপত্তি, সংজ্ঞা এবং এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা কর।

রোমান্টিসিজম কি,রোমান্টিসিজম কাকে বলে


রোমান্টিসিজমের উৎপত্তি কোথায়


রোমান্টিসিজম একটি আধুনিক মতবাদ।ল্যাটিন রোমান্স থেকে রোমান্টিক শব্দের উৎপত্তি। পরবর্তীতে রোমান্টিকতা যখন একটি আন্দোলনের রূপ নেয় তখন তা একটি ইজম বা তত্ত্বে পরিণত হয়। Romantic শব্দটি Classical শব্দের বিপরীত শব্দ।রোমান্টিসিজমের বাংলা রোমান্টিকতাবাদ।  কোন কোন পন্ডিত রোমান্টিক শব্দটির প্রতিরূপে 'আত্মপন্থী' 'বিষয়ীপ্রধান'  শব্দ ব্যবহার করেছেন। তবে রোমান্টিক শব্দটি অনেক বিদেশি শব্দের মতো বাংলা ভাষায় রোমান্টিক রূপেই স্থান করে নিয়েছে। 


অধিকাংশ পণ্ডিতের অভিমত, প্রাচীন ফরাসি Romanz শব্দ থেকে রোমান্টিক শব্দটি এসেছে। ফরাসিরা আগে রোমান্টিক শব্দের আগে রোমানেস্ক শব্দটি ব্যবহার করতো-যার অর্থ ছিলো অপ্রচলিত,অভিযান বিষয়ক বা বন্য ইত্যাদি।ক্লাসিক ভাষা ল্যাটিনের পরিবর্তে রোমানা নামে প্রাকৃত এই ভাষাটিতে প্রথম মধ্যযুগে ফরাসি গাথাকাব্য বা কাহিনি কাব্য লেখা শুরু করে এবং পরে এই ভাষায় ধীরে ধীরে মুখ্যত সামরিক অভিযান নির্ভর কল্পকাহিনি লেখা শুরু হয়।এসকল কাহিনী যখন বাস্তব অপেক্ষা অবাস্তব, সত্য অপেক্ষা কল্পনা, কার্যকারণ সম্পর্ক লংঘন করে অলিক, ভাবাবহ আশ্চর্য, ভাবানুভূতি জাগ্রত করল তখন তাকে বিশেষভাবে রোমান্টিক নামে বলা শুরু হল। 


১৭৮৯ সালে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের পরে রোমান্টিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। শিল্প সাহিত্য, দর্শন, এমনকি রাজনীতি থেকে একটি বিশেষ ধরনের আবেগ, অনুভূতি, উপলব্ধি ও মানসিক সচেতনতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এসেছে।বৃহত্তর অর্থে এ ধরনের আবেগ, অনুভূতি, উপলব্ধি ও মানসিক সচেতনতাকে রোমান্টিক আন্দোলন নাম দেওয়া হয়।এখন ইউরোপের ইতিহাসে সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে রোমান্টিক একটি যুগ-কাব্য, দর্শন, শিল্পকলা ও সঙ্গীত দিয়ে গড়া একটি আন্দোলন বা জাগরণের নাম। ইতিহাসবেত্তাগণ বলেনঃ রোমান্টিসিজমই ছিলো জীবনের দিকে ইউরোপের শেষ সম্মিলিত অথবা সাধারণ অগ্রযাত্রা। 


ড. হুমায়ন আজাদ মনে করেন,রোমান্টিক আন্দোলন 'মানবজাতির সৃষ্টিশীলতার নাম' এবং মানবচেতনার এক মহাবদল-যা ভাঙন ধরিয়ে দেয় বিশ্ব চিন্তাধারার মেরুদন্ডে।'


রোমান্টিসিজম কাকে বলে

রোমান্টিকতার মূল সুর হলো প্রচণ্ড কল্পনা প্রবনতা। রোমান্টিক শিল্পী, কবি সাহিত্যিকরা তাদের অনুভূতি ও কল্পনাকে এমনভাবে প্রকাশ করেন যেখানে মনের ভিতরে একটা বাষ্পমান আবেগ সৃষ্টি হয়। তারা তাদের কল্পনা প্রতিভার মাধ্যমে বিশ্ব জগত ঘুরে বেড়ান। অকারণ বেদনাবোধই হচ্ছে রোমান্টিক কবি বা শিল্পীর মূল স্বভাব। 


রোমান্টিক শব্দটির অর্থ তীব্র কল্পনাশক্তির প্রকাশ


Herford রোমান্টিকের সংজ্ঞা দিয়েছেন-"An extraordinary development of imaginative sensibility".

কল্পনা শক্তির অসাধারণ বিকাশই রোমান্টিক শিল্পের বৈশিষ্ট্য। 

কেউ কেউ বলেছেন, রোমান্টিক ভাবকল্পনার বিশেষত্ব হচ্ছে বিস্ময় রসের পুনর্জীবন।


রোমান্টিসিজমের  সংজ্ঞা


শিল্পসাহিত্যে রোমান্টিসিজম একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি, রূপ বা ধারা-যেখানে শিল্পী তাঁর অসাধারণ কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে,আপন মনের গভীর অনুভূতিসণ্জ্ঞাত ভাবাবেগকে,জীবনের বাস্তবতা ও প্রাত্যহিকতাকে, তার চারপাশের ও অন্তর্দৃষ্টির বিষয়বস্তুকে বাস্তবাতীত প্রজ্ঞাস্পর্শধন্য এক অপূর্ববস্তুতে রূপায়িত করেন,তার নামই রোমান্টিকতা।আর সেই মতবাদের নাম রোমান্টিসিজম।


রোমান্টিসিজম এর বৈশিষ্ট্য কি

 
১)কল্পনা শক্তির উপর ভিত্তি করে এই ধারার শিল্পীগণ শিল্প রচনা করেন। এই শ্রেণীর শিল্পীদের বিশ্বাস, কল্পনাই তাদের মূল মানসশক্তি এবং এই শক্তির কারণেই তারা শিল্পী। তারা জোর দিয়ে বলেন, জগতের যে রূপ আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ তা সীমিত ও খন্ডিত।ফলে অপূর্ণ ও।তাই বস্তুর পূর্ণরূপ বা অভ্যন্তরীণ সত্যরূপ শুধু কল্পনা দিয়ে আবিষ্কার সম্ভব।অতলস্পর্শ ভাবতন্ময়তা তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। 

 ২)বিষয় নির্বাচনে রোমান্টিক শিল্পী অন্তর্মুখী। কবি নিজেকে দেখেন- নিজের ভেতরে চোখ মেলে, শোনেন নিজেকে- নিজের ভেতর কান পেতে।তারা বলেন- নিজের ভেতরে ডুব না দিলে মানুষ জগতের রহস্য জানতে পারেনা। নিজের কথার সঙ্গে অতি তুচ্ছ ও সাধারণ বিষয় ও তাদের কবিতায় অসাধারণত্ব লাভ করে।অনেক সময় বিষয়ে ও ঘটনা বিন্যাসে তারা সংযম রক্ষা করতে পারেননা। অন্তর্মুখী হওয়ার স্বভাবতই আবেগের প্রাধান্য থাকে। অন্তর্মুখী প্রবণতার প্রাধান্য বেশি থাকে বলে তাদেরকে কোন কোন পন্ডিত আত্মকেন্দ্রিকতাবাদী বলে থাকেন। 

৩)এ শ্রেণীর লেখক ও শিল্পীগণ অজানার আকর্ষণে সাড়া দেন।যা দূরের, যা দূর্লভ, যা অস্পষ্ট তার জন্য আকুতিই তাদের বেশি। এ কারণে রোমান্টিসিজমের বৈশিষ্ট্য অসীমের প্রতি অপ্রতিহত ভালোবাসা, বৈচিত্রের প্রতি অপ্রত্যাশিত অনুরাগ। কবি এখানে উদার, উন্মুক্ত। আবেগের স্রোতে ভেসে তিনি জীবনের গভীরতর কোন মহৎ সত্যকে তুলে আনেন।

 ৪)প্রকৃতির বিশালত্ব ও রহস্যময়তা এই ধারার শিল্পীদের প্রবল আকর্ষণ এর বিষয়।প্রকৃতিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তাকে মানবায়িত করেন এই ধারার শিল্পীগণ।প্রকৃতি তাঁদের কবিতায় আগের কবিদের মতো পটভূমি বা কাহিনির সহযোগী হয়ে আসেনি।প্রকৃতি রোমান্টিক কবিদের কাছে সজীবসত্তা,আত্মিক প্রেরণা-আনন্দ ও সান্ত্বনার স্থল।

 ৫) রোমান্টিক লেখকদের লেখায় আন্তরিকতা ও উচ্ছ্বাস বেশি। এ কারণে তাদের অনেকেরই লেখায় সঙ্গীতধর্মী তা-ও চিত্রধর্মিতার প্রাধান্য রয়েছে। তাদের লেখায় অতিকথন যেমন আছে তেমনি আছে অলংকারের বাহুল্য। আবার তাদের অনেকের লেখায় অস্থিরচিত্ততার প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। 

৬)রেনেসাঁ ও ফরাসি বিপ্লব মানুষের মর্যাদা কে প্রতিষ্ঠা করল। রোমান্টিক শিল্পী মানুষের এই মূল্যায়ন কে স্বাগত জানায়। তাদের কাছে জগতের সব মানুষই অনন্য। 

 ৭)এই শ্রেনীর কবিদের লক্ষ্য ছিল, কবিতাকে আগের কবিদের মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবনা থেকে মুক্ত করে হৃদয় প্রসূত করা। তারা যুক্তি ও বুদ্ধির স্থলে আবেগ ও প্রাণময়তার প্রকাশ ঘটান। কবিতা তাদের কাছে কোন কারিগরি বিষয় নয়। তারা মনে করেন, কবিতা জন্ম নেয় গাছের মতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে। 

 ৮)ক্লাসিক কবিদের নগর সভ্যতা ও নগর জীবনের ভাষাকে পরিহার করে রোমান্টিক কবিগণ প্রতিষ্ঠা দিলেন গ্রামীণ ও সাধারণ মানুষের ভাষা।

৯)প্রাচীন গ্রিক শিল্পসাহিত্যের অনুরাগ ও অনুসৃতির মধ্য দিয়ে 'সত্য ও সুন্দরকে' প্রতিষ্ঠার প্রবণতা অনেক রোমান্টিক শিল্পীদের রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।  

১০) রোমান্টিক আন্দোলন অনুকরণবাদ কে পরিহার করে। প্রকাশবাদ কে তারা গ্রহণ করে। সাবলীল প্রকাশ বা উপস্থাপনকে তারা বেশি গুরুত্ব দেন। 


সুতরাং পরিশেষে বলা যায় রোমান্টিসিজম একটি সাহিত্য আন্দোলন।যার উদ্ভব ইউরোপে হলেও এর বিস্তার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটে। মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা এবং তা প্রকাশের স্বাধীনতা হিসেবে রোমান্টিসিজম আন্দোলন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ-এক অর্থে রোমান্টিকতার মধ্যেই নিহিত ছিল আধুনিকতার বীজ।


FAQS

রোমান্টিসিজম কি
রোমান্টিসিজম এর বৈশিষ্ট্য কি
রোমান্টিসিজম কাকে বলে
রোমান্টিসিজমের উৎপত্তি কোথায়

কোন মন্তব্য নেই

enot-poloskun থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.