এরিস্টটল তাঁর পোয়েটিকস গ্রন্থে ট্রাজেডিকে কয় শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন?এবং সেগুলি কী কী? সে সম্পর্কে আলোচনা কর।
এরিস্টটল তাঁর পোয়েটিকস গ্রন্থে ট্রাজেডিকে কয় শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন?এবং সেগুলি কী কী? সে সম্পর্কে আলোচনা কর।

নাট্য সাহিত্যের একটি প্রাচীনতম ফর্ম ট্রাজেডি। এটি উচ্চ মাপের একটি ষড়ঙ্গ শিল্প। প্রাচীন গ্রিস থেকে অদ্য ট্রাজেডির রচনা আলোচনা প্রবাহমান।যুগে যুগে এই সাহিত্য ফর্মটিতে যুক্ত হয়েছে নতুন মাত্রা এবং হয়ে উঠেছে বৈচিত্র্যময়। সাহিত্যতত্ত্বের বাইবেল খ্যাত, ইউরোপীয় সমালোচনা সাহিত্যের প্রথম গ্রন্থ গ্রিক পন্ডিত এরিস্টটলের(খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২) পোয়েটিকস গ্রন্থের বারো আনা স্থান দখল করে আছে এই ট্রাজেডি আলোচনা। প্রাচীন গ্রিসে ট্রাজেডি সাহিত্য সবচেয়ে বেশি বিকশিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ইংরেজি সাহিত্যের প্রাণপুরুষ উয়িলিয়াম শেকসপিয়র এতে যুক্ত করেন নতুন মাত্রা। সুতরাং এরিষ্টটল ট্রাজেডিকে শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যিক রূপকল্প বলে গণ্য করেন।প্রাচীন গ্রিক সাহিত্যে ট্রাজেডির গুরুত্ব অপরিসীম।
ট্রাজেডি কয় শ্রেণীতে বিভক্ত?
অ্যারিস্টোটল তাঁর পোয়েটিক্স গ্রন্থের আঠারো অধ্যায়ে ট্রাজেডিকে ৪ শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। যেমনঃ
- ১.জটিল ট্রাজেডি
- ২.দুর্ভাগ্যের ট্রাজেডি
- ৩.চরিত্রের ট্রাজেডি
- ৪.দৃশ্যের ট্রাজেডি
নিম্নে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ
১)জটিল ট্রাজেডি
অ্যারিস্টোটল জটিল ট্রাজেডি সম্পর্কে বলেন, এ ট্রাজেডি সম্পূর্ণভাবেই বিপ্রতীপতা এবং উদঘাটনের ওপর নির্ভরশীল। এ সকল ট্রাজেডিতে একটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে কাহিনী সত্যে উপনীত হয়। এই বিপর্যয় ও বিপর্যয়ের পর উদঘাটন দর্শকচিত্তে ভয় ও করুণা জাগিয়ে দেয়। যেমন সফোক্লিসের ইডিপাস নাটক।
নাট্যতত্ত্ববিদ ড. সাধন কুমার ভট্টাচার্য্য ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, এই জাতীয় নাটকে ট্রাজেডির মূল রস ভয়ানক ও করুন তো থাকেই, অধিকন্তু থাকে অদ্ভুত রস। অর্থাৎ এই সব নাটকে বিস্ময়-ভয়-শোচনা এই তিন ভাবের সংমিশ্রণ ঘটে এবং বিস্ময়ের মাত্রা বেশি থাকায় চিত্তে শোচনার মাত্রা উদ্রেক হওয়া সত্বেও চিত্ত দ্রবীভূত হয় না।এই জাতীয় নাটকে 'awe' (ভয়,আতঙ্ক) এবং 'grandeur' (মহিমা,বিশালতা) বেশি থাকে এবং এই শ্রেনির নাটককে এরিস্টোটল উত্তম বা পারফেক্ট বলে ঘোষণা করেছেন।
২)দুর্ভাগ্যের ট্রাজেডিঃ
মূল গ্রিক থেকে ইংরেজি অনুবাদ করা হয়েছে প্যাথেটিক (Pathetic) ট্রাজেডি আর বাংলা করা হয়েছে দুর্ভাগ্যের ট্রাজেডি। ইংরেজি অনুবাদে বন্ধনীর মধ্যে এজাতীয় নাটকের বৈশিষ্ট্য ব্যক্ত করতে বলা হয়েছে হয়েছে (where the motive is passion) অর্থাৎ এই নাটকের লক্ষ দুঃখ বা দুঃখবোধ। কেউ কেউ প্যাথেটিক এর বাংলা করেছেন যন্ত্রণা ট্রাজেডি।
এরকম ট্রাজেডির উদাহরণ দিতে গিয়ে এরিস্টোটল আজাক্স এবং ইক্সিয়ন নামের দুটো নাটকের উদাহরণ দিয়েছেন।
এ ধরনের ট্রাজেডিতে নায়ক নিজেই ভুল করে বিপদে পড়ে একটি করতে গিয়ে আরেকটি করে ফেলে এবং পরিণামে মৃত্যুর ও অধিক যন্ত্রণা বহন করে। নায়কের বিক্ষোভ ও বিলাপ প্রকাশের মধ্য দিয়ে করুন রস সৃষ্টি করাই এ ধরনের ট্রাজেডির উদ্দেশ্য।
আধুনিককালে অনেক পণ্ডিত এই 'প্যাথেটিক ট্রাজেডি' নামে আলাদা শ্রেণি করতে নারাজ। কারণ ট্রাজেডিতে প্যাথেটিক তো থাকবেই।প্যাথেটিক না থাকলে ট্রাজেডি হবে কেমন করে।
৩)চরিত্রের ট্রাজেডিঃ
এ ধরনের ট্রাজেডিতে চরিত্রের ট্রাজেডিকে বিশেষ ভাবে তুলে ধরা হয়। কোন কোন নাটকের কাহিনী প্রাধান্য লাভ করে এবং দর্শক কাহিনীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। কিন্তু চরিত্র সমৃদ্ধ ট্রাজেডিতে দর্শক চরিত্রের প্রতি ঝুঁকে থাকে। চরিত্রের বিপর্যয়, পতন দর্শককে অধিক প্রভাবিত করে। চরিত্রটিকে ঘিরেই ট্রাজিক বলয়টি নির্মিত হয়।অ্যারিস্টোটল তাঁর এই বক্তব্যে 'থিয়টাইডেস' এবং 'পেলেউস' নামক দুটি নাটকের উদাহরণ দিয়েছন।
৪)দৃশ্যসমৃদ্ধ ট্রাজেডিঃ
এই ট্রাজেডির নাম থেকেই বোঝা যায়,এ ধরনের ট্রাজেডীতে দৃশ্য একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বস্তুতপক্ষে দৃশ্য সংযোজনের মাধ্যমে নাট্যকার সহজেই পরিবেশটিকে বুঝাতে পারেন। অবশ্যই এ ধরনের নাটকে দৃশ্যের সাহায্যে বক্তব্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এখনো, সারা বিশ্বেই দৃশ্য নাটকের ভাব বা রস বুঝতে সহায়তা দান করে।অ্যারিস্টোটলের সময়ে নাট্যমঞ্চের যে অবস্থা ছিল, তা থেকে বর্তমান নাটক অনেকদূর এগিয়ে এসেছে। ফলে নাটকের নাট্যমঞ্চ সজ্জায় এসেছে বিরাট পরিবর্তন। তখন পর্যন্ত মঞ্চের তিন দিকই খোলা ছিল।
এখানেও এরিস্টটল 'ফরসাইড' ও 'প্রমেথিউস' নামের দুটো নাটকের সঙ্গে হাদেসের দৃশ্যসংবলিত নাটকের কথা উল্লেখ করেছেন। সে সময়েও বোধ হয়, এমন নাটক উপস্থাপন করা হয়েছিল, যেখানে অতিরিক্ত দৃশ্য সন্নিবেশ করা হয়েছিল।
ট্রাজেডি কাকে বলে আরো জানতে ক্লিক করুন
সুতরাং পরিশেষে বলা যায় যে, অ্যারিস্টোটলের সর্বাধিক পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বিশেষণের বিজ্ঞান মনস্কতার কারণে ট্র্যাজেডি-সাধারন নাট্যানুষ্ঠান থেকে ষড়ঙ্গ শিল্প অধ্যায়ে উন্নীত হয়েছে এবং তার এই ট্রাজেডি তত্ত্ব এখনো সমাদৃত হচ্ছে। তিনি ইউরোপীয় সাহিত্য সমালোচকদের গুরু এবং তার ট্রাজেডি তত্ত্ব সাহিত্যতত্ত্বই শ্রেষ্ঠ সাহিত্য তত্ত্ব।
কোন মন্তব্য নেই