মহাকাব্য কী, এরিস্টটলের মতানুসারে মহাকাব্যের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য

মহাকাব্য কী, এরিস্টটলের মতানুসারে মহাকাব্যের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।

মহাকাব্য কি কাকে বলে



প্রাচীন গ্রিসের অন্যতম সৃষ্টিক্ষম প্রবক্তা,বিশিষ্ট দার্শনিক হচ্ছেন এরিস্টটল (খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২)।এরিস্টটলের বিখ্যাত গ্রন্থ হচ্ছে পোয়েটিকস।তার এই কাব্যনির্মাণতত্ত্ব গ্রন্থটি বিশ্বজনীনতা লাভ করেছে।তার মূলে রয়েছে এরিস্টটলের অন্তর্দৃষ্টি,প্রতিভা এবং সাহিত্যবোধের গভীরতা।কাব্যনির্মাণতত্ত্বগ্রন্থে ট্র্যাজেডির পর তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন মহাকাব্যের উপর।পোয়েটিকসের ত্রয়োবিংশ থেকে ষড়বিংশ অধ্যায় পর্যন্ত মহাকাব্যের নানা দিক এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।নিম্নে মহাকাব্যের সংজ্ঞা এবং তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলঃ

মহাকাব্য কি ও কাকে বলে

পোয়েটিকসের পঞ্চম অধ্যায়সহ আরও বিভিন্ন স্থানে এরিস্টটল মহাকাব্যের বিষয়াদি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।কিন্তু তার পরেও তিনি মহাকাব্যের কোনো সংজ্ঞা প্রদান করেননি।
তবে মহাকাব্য সম্পর্কে তার প্রদত্ত বিভিন্ন ধারণার আলোকে বলা যায় যে,

"যে কাব্য পরিসরে বিশাল ও বিস্তৃত ,বর্ণনাত্মক রীতিতে রচিত,বিষয়ের অনুকরণে গভীর ও গম্ভীর এবং কর্মকান্ডের দিক থেকে মননশীল সেই কাব্যকেই মহাকাব্য বলা হয়।

মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী

এরিস্টটল তাঁর পোয়েটিকস কাব্যগ্রন্থে মহাকাব্য সম্পর্কে যে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন,এ আলোচনার মাধ্যমে মহাকাব্যের যেসব বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়, তা নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ

১)মহাকাব্য পদ্য বা শূর ছন্দে রচিতঃ

মহাকাব্যের প্রথম এবং প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ছন্দ।মহাকাব্য যেহেতু কাব্যবিশেষ তাই তা পদ্য বা ছন্দে রচিত হবে।এরিস্টটল বলেছেন,মহাকাব্য গদ্যে রচিত হবে না,হবে পদ্যে এবং তিনি এক বিশেষ ছন্দের কথা উল্লেখ করেছেন।এই বিশেষ ধরনের ছন্দ হলো ষটপদী বা শূরছন্দ বা Hexameter।
Hexameter কথাটির আগে তিনি Heroic বা বীরত্বপূর্ণ কথাটি ব্যবহার করেছেন।এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে,মহাকাব্যের সাথে বীরত্ব বা বীররসের বিষয়টি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। ষটপদী ছন্দই গুরুগম্ভীর, ধ্বনিময়, উদাত্ত, অভিজাত, পৌরুষদীপ্ত এবং বীরত্বপূর্ণ। মহাকাব্যের এই বৈশিষ্ট্যময় ছন্দের ভাবের সাথে কাহিনীর ও যথেষ্ট সামঞ্জস্য রয়েছে। এই জন্যই এরিস্টটল  মহাকাব্যের জন্য এই বিশেষ শ্রেণীর ছন্দের কথা বলেছেন। এ কথা বলা যায় বিশেষ এই ষটপদী বা Hexameter ছন্দটি বিশেষভাবে মহাকাব্যের জন্য উপযুক্ত এবং নির্ধারিত ছন্দ।

২)মহাকাব্য গম্ভীর ও গভীর বিষয়ের অনুকরণঃ

তারপর আসে মহাকাব্যের গাম্ভীর্য।মহাকাব্য সিরিয়াস ইমিটেশন অর্থাৎ ভাবগম্ভীর অনুকরণ। আসলে মহাকাব্যিক বা Hexameter ছন্দই গুরুগম্ভীর,অভিজাত এবং উদাত্ত ধ্বনিময়। বলা যায় মহাকাব্যের উদাত্ত, মহান এবং ভাবগম্ভীর ঘটনা বা ভাববস্তুর সাথে ষটপদী ছন্দের গাম্ভীর্য ও ঔদার্য  ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক যুক্ত। সুতরাং সব মিলিয়ে মহাকাব্য গুরুগম্ভীর,উদাত্ত উচ্চ শ্রেণীর সাহিত্য বিশেষ। এরিস্টটল স্পষ্টতই মহাকাব্যকে গভীর ও গম্ভীর বিষয়ের অনুকরণ বলে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ মহাকাব্য অনুকরণ শিল্প এবং অনুকরণ এর বিষয়টি হালকা বা চটুল হবে না, হবে বীররসাত্মক ও গুরুগম্ভীর।

৩)মহাকাব্যের রীতি বর্ণনাত্মকঃ

মহাকাব্য শ্রবকাব্য।
'বর্ণনাত্মক কাব্যিক রীতিতে রচিত হবে'।কাহিনি গড়ে ওঠবে আদি-মধ্য-অন্ত সম্বলিত সম্পূর্ণ ও পরিপূর্ণ একটি মাত্র ঘটনাকে কেন্দ্র করে যাতে একটি পরিপূর্ণ একক জীবদেহের মতো ঘটনাপঞ্জি, বর্ণনার ভঙ্গিতে মহাকাব্যে রচিত হয়।

এরিস্টোটল বলেছেন,মহাকাব্যের কবি 'নিজে উত্তম পুরুষে খুব কম কথা বলবেন'। কারন উত্তম পুরুষে উপস্থাপনের শিল্প মহাকাব্য নয়। হোমারের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছেন 'খুব সামান্য ভূমিকার পরই সরাসরি কোন পুরুষ বা নারী বা অন্য কাউকে উপস্থাপন করেন' তিনি।

৪)মহাকাব্যের পরিসর বিস্তৃত এবং বৃহৎঃ

মহাকাব্যের পরিসর ব্যাপক ও বিস্তৃত।মহাকাব্যের নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই,যেমন আছে ট্রাজেডির ক্ষেত্রে।এরিস্টটল মহাকাব্যের বিস্তৃত পরিধির কথা বলেছেন।তাঁর মতে,মহাকাব্য কোন কালসীমার গন্ডি মেনে চলেনা।

তিনি আরো বলেনঃ
ট্রাজেডিকে যেমন 'সূর্যের এক আবর্তন সময়কাল বা তার চেয়ে একটু বেশি সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ' রাখতে হয়,তেমনটি মহাকাব্যকে রাখতে হয়না বলে সঙ্গতকারণেই যুক্ত করা যেতে পারে বিভিন্ন উপকাহিনি,ঘটনাবলি।এগুলো কাব্যের গুরুত্ব বাড়ায়,স্বাদে আনে ভিন্নতা এবং কাব্যকে ঐশ্বর্যমন্ডিত করে।

এরিস্টটল মনে করেন,আকৃতিতে বড় হলে প্রকৃতিতেও হতে পারে মহত্ত্বতর।

৫)মনন ও রচনাশৈলী হবে উন্নতমানেরঃ

মহাকাব্যের মনন ও রচনাশৈলী হবে উন্নতমানের। এরিস্টটল পোয়েটিকসের বাইশ অধ্যায়ে এ বিষয়ে কথা বলেছেন।

তাঁর মতে,উন্নত রচনাশৈলী ও মনন প্রকাশের জন্য লেখককে 'গতানুগতিক না হয়েও হতে হবে স্বচ্ছ'।পরিচিত ও অপরিচিত শব্দের মিশালে তৈরি করতে হবে মহাকাব্যিক আভিজাত্য।অলঙ্কার ব্যবহার করতে হবে বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে।

৬)অলৌকিকতাঃ

মহাকাব্যে অলৌকিকত্ব থাকতে পারে।কারণ অভিনয়কারী ব্যক্তিরা আমাদের চোখের সামনে থাকেনা সেহেতু ব্যাখ্যার বাহিরেও কিছু থাকতে পারে।

সুতরাং পরিশেষে বলা যায় যে,মহাকাব্য ট্রাজেডির চেয়ে কয়েকগুন বড় এবং কয়েকটি ট্রাজেডির সমষ্টি হতে পারে একটি মহাকাব্য,এমন মন্তব্য করেছেন এরিস্টটল। মহাকাব্য যেহেতু বর্ণনাত্মক, সেহেতু এর দৈর্ঘ্য বিস্তারের সুযোগ আছে যা ট্রাজেডিতে সম্ভব নয়।নাটক বা ট্রাজেডি সংলাপনির্ভর,তার দৈর্ঘ্য বিস্তারের সুযোগ নেই।
মহাকাব্যে একাধিক ঘটনার বর্ণনা দেওয়া সম্ভব,তাই তা হয়ে উঠে বৈচিত্র্যময়।

কোন মন্তব্য নেই

enot-poloskun থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.