অতৃপ্তিবোধ সাহিত্যিকদের ঘিরে থাকলেও তাঁরা চূড়ান্তভাবে হতাশ হন না কেন ? বাংলা সাহিত্যের দৃষ্টান্ত ব্যবহার করে বিষয়টি বিশ্লেষণ কর

অতৃপ্তিবোধ সাহিত্যিকদের ঘিরে থাকলেও তাঁরা চূড়ান্তভাবে হতাশ হন না কেন ? বাংলা সাহিত্যের দৃষ্টান্ত ব্যবহার করে বিষয়টি বিশ্লেষণ কর

বাংলা সাহিত্য




সাহিত্য শিল্পীগণ যখন ‘অন্তর হতে বচন আহরণ’ করে আত্মপ্রকাশ কলায় ‘গীতরস ধারায় সিঞ্ঝন করে আনন্দলোকে নিজের কথা-পরের কথা-বাইরের জগতের কথা আত্মগত উপলব্ধির রসে প্রকাশ করেন-তখনই তা হয়ে ওঠে সাহিত্য।একজন সাহিত্যস্রষ্টার কল্পনালোকে ‘সংসার ধুলি জালে’র মাঝখান হতে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত ধরা পড়ে সমভাবে-তার দৃষ্টি-সৃষ্টি অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।একজন সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্য রচনার পথে বিভিন্ন রকম স্বপ্ন দেখেন-স্বপ্ন দেখেন একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের-স্বপ্ন দেখেন শোষণমুক্ত একটি পৃথিবীর কিংবা নিজের রচনা দিয়ে জনসাধারণের মঙ্গল সাধন করতে; কিন্তু অনেক সময় সাহিত্যিকের স্বপ্ন সফল না ও হতে পারে; তাকে অতৃপ্তিবোধ ঘিরে থাকে- তাই বলে তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন না-আবার নতুন স্বপ্নের রংতুলিতে আগামী পৃথিবীর মানুষের জন্য সুন্দর একটি স্বপ্ন রচনা করেন।



আসলেই যে কথাই বলিনা কেন সাহিত্যিক ও মানুষ-সমাজের বাসিন্দা-সমাজের নানা কর্মে তিনিও নিবিড়ভাবে জড়িত।সাহিত্যসৃষ্টি তো ঘরের কোনো এক খিল দেওয়া কামরায় সৃষ্টি হয় না-তাই সমাজের বৃহত্তর জীবনের উর্বর অনুর্বর ভূমি,ঘটনাপ্রবাহ সাহিত্যিকের পক্ষেও এড়িয়ে চলা অসম্ভব।তাই সাহিত্যিকদের ভালো মন্দবোধ দ্বারা তাড়িত হতে হয়,নিজের সাহিত্য সম্পর্কে সচেতন হতে হয়।আবেগ দ্বারা সাহিত্যিকেরা সাহিত্য রচনা করলেও তারা কখনো বাস্তববিবর্জিত নন-বাস্তবের কঠিন মাটিতে পা রেখেই নিজেদের ব্যর্থতা-সফলতা নিঃশঙ্কোচে-দ্ব্যর্থহীনভাবে স্বীকার করেন।বাংলা সাহিত্যিকদের লেখকদের সম্পর্কেও এই একই  মন্তব্য প্রযোজ্য।নিচে উদাহরণসহ বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।



“জন্মদিনে” কাব্যগ্রন্থের ১০ সংখ্যক ‘ঐকতান’ কবিতাটি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের[১৮৬১-১১৯৪১] আত্ম-সমালোচনা; কবি হিসেবে নিজের অপূর্ণতার স্বতঃস্ফূর্ত স্বীকারোক্তি।দীর্ঘ জীবনের শেষপ্রান্তে পৌছে রবীন্দ্রনাথ পেছন ফিরে তাকিয়ে সমগ্র জীবনের সাহিত্যসাধনার সাফল্য ও ব্যর্থতার হিসাব খুঁজেছেন ‘ঐকতান’ কবিতায়।তিনি অকপটে নিজের সীমাবদ্ধতা-অপূর্ণতা-অতৃপ্তিবোধের কথা ব্যক্ত করেছেন।জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কবি অনুভব করেছেন নিজের ব্যর্থতার কথা।কবি বুঝতে পেরেছেন,এই পৃথিবীর অনেক কিছুই তাঁর অজানা ও অদেখা রয়ে গেছে।বিশ্বের বিশাল আয়োজনে তার মন জুড়ে ছিল কেবল ছোট একটি কোণ।অতৃপ্তিবোধের কারণেই নানা দেশের বিচিত্র অভিজ্ঞতা,বিভিন্ন গ্রন্থের চিত্রময় বর্ণ্নার বাণী কবি ভিক্ষালব্ধ ধনের মতো সযত্নে আহরণ করে নিজের কাব্যভান্ডার পূর্ণ করেছেন।তবু কবি তৃপ্ত হতে পারেননি।কবি বলেছেন-



                             “বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।
                               দেশে দেশে কত-না নগর রাজধানী-
                         মানুষের কত কীর্তি,কত নদী গিরি সিন্ধু মরু,
                         কত-না অজানা জীব,কত-না অপরিচিত তরু
                         রয়ে গেল অগোচরে।বিশাল বিশ্বের আয়োজন;
                        মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্র তারি এক কোণ।
                        …………………………………………………
                         এই স্বর সাধনায় পৌছিল না বহুতর ডাক-
                                          রয়ে গেছে ফাঁক ।”




রবীন্দ্র পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে কাজী নজরুল ইসলাম [১৮৯৯-১৯৭৬] সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক সাহিত্যিক।আগাগোড়া তিনি মানবতাবাদী ছিলেন বলেই তিনি অসাম্প্রদায়িক কবি।নজরুল ইসলাম বাংলা কাব্য সাহিত্যাঙ্গনে সর্বপ্রথম এবং সরাসরি পুরোপুরি মাত্রায় ব্রিটিশ বিরোধী কবি।যিনি প্রথম বাঙ্গালি কবি হিসেবে জেল খেটেছেন।তিনি সারাজীবন দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সাহিত্য রচনা করেছেন এবং সরাসরি আন্দোলন-সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন।তিনি এককভাবে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙতে না পারলেও তিনি হতাশা হননি।তিনি চরম অতৃপ্তিবোধ নিয়ে আশাবাদী চেতনায় উচ্চারণ করেছেন এভাবে-



                              “মহা বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
                                আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উতপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধবনিবে না,
           অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-
                                বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
                              আমি সেই দিন হবো শান্ত।




তিরিশের দশকের বাঙালি কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশ[১৮৯৯-১৯৫৪] একজন প্রধান কবি।মনন-মেধায়,চিন্তা-চেতনায়,চিত্রকল্প রচনায়,বিষয় নির্বাচনে,আঙ্গিক নির্মাণে তাঁর কাব্য প্রতীভা স্বকীয় স্বতন্ত্রধারা অনুসারী ও বিস্তারী।ফলে তাঁর কাব্যে বিষয়গত ভাবে যেমন প্রকৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য চেতনা ঐক্যসূত্রে গ্রথিত হয়ে গেছে,তেমনি আঙ্গিকে এসেছে অভিনবত্ব।বাংলার রূপমুগ্ধ কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলা কাব্যে ‘রূপসী বাংলা’র কবি হিসেবেই পরিচিত। তাঁর কাব্যগ্রন্থসমূহ ‘রূপসী বাংলা’র শাশ্বত স্বপ্নরূপ।এ কাব্যে কবি বাংলার অন্তরঙ্গ রূপ অসাধারণ ক্ষমতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। কাব্যের কবিতাগুলিতে প্রকৃতির সৌন্দর্য-মুগদ্ধতা জৈবিক জীবনের সঙ্গে মিলে মিশে গেছে।কিন্তু তারপরেও বাংলাকে দেখার স্বাদ কবির পূরণ হয়নি-তাইতো তিনি অতৃপ্তি নিয়ে বলেছেন-


                     “তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও
                      আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব;
                 দেখিব কাঁঠাল পাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে।”


এই অতৃপ্তি কবিকে থামাতে পারেনি।কেননা মৃত্যুর পরও তিনি সাধারণ মানুষের কাছেই ফিরে আসতে চেয়েছেন সামান্য জীব হয়ে-যা কবির “রূপসী বাংলা” কাব্যের “আবার আসিব ফিরে” কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে-


                  “আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে-এই বাংলায়
                   হয়তো মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে;
                   হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে
                    কুয়াশার বুক ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল-ছায়ায়।”




রবীন্দ্র-নজরুল-উত্তর বাংলা কবিতার ইতিহাসে যিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন অন্যায়-অত্যাচার,নিপীড়িত-নির্যাতনের বিরুদ্ধে আর সংগ্রামী সততা নিয়ে তিনি হলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য[১৯২৬-১৯৪৭] ।যে কবি খুবই অল্প সময়ে জনগণের ও জনমনের অনেক কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছিলেন।শোষিত মানুষের জীবন যন্ত্রণা,বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের হুঙ্কারে তার কবিতায় ব্যক্ত হয়ে উঠেছে।তিনি ছিলেন মূলত নতুন যুগ-চেতনার প্রতিনিধি।কবি সুকান্তের বাল্য,কৈশোর ও তারুণ্য কেটেছে এক রাজনৈতিক অস্থিরতার কালপর্বে।জন্ম মাত্রই কবি স্বদেশকে পরাধীন দেখেছেন।নিজ রচনায় কবির ক্রোধ-অতৃপ্তিবোধ তীব্রভাবে প্রকাশিত হয়েছে।তার এই ক্রোধ উৎসারিত হয়েছে সাধারণ বঞ্চিত,শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের প্রতি।বিল্পবী কবি তার কবিতায় পৃথিবীকে সম্বোধন করে উচ্চারণ করে গণমুখী বাণী-



                                     “ অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি,
                                    জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশ ভূমি।
                                     অবাক পৃথিবী আমরা যে পরাধীন
                                    অবাক,কী দ্রুত জমে ক্রোধ দিন দিন;
                                         এদেশে জন্ম পদাঘাতই শুধু পেলাম,
                                  অবাক পৃথিবী সেলাম,তোমাকে সেলাম।”




সুতরাং সার্বিক বিচারে বলা যায় যে,অতৃপ্তিবোধ সাহিত্যিকদের ঘিরে থাকলেও তারা চূড়ান্তভাবে হতাশ হন না।কেননা সাহিত্যিকেরা বিশ্বাস করেন এবং জানেন অন্ধকারের পরেই আলোর রেখা ফুটে ওঠে।এ কারনে তাঁরা তাদের আশাকে আরো দ্বিগুন করে সাহিত্য রচনায় অগ্রসর হন ইতিবাচক চেতনায়।


কোন মন্তব্য নেই

enot-poloskun থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.