ফররুখ আহমদের 'সাত সাগরের মাঝি' কাব্যে মুসলিম পুনর্জাগরণের স্বপে বিভোর কবিচিত্তের যে ব্যাকুল জিজ্ঞাসা উচ্চারিত তার স্বরূপ বিশ্লেষণ কর

 ফররুখ আহমদের 'সাত সাগরের মাঝি' কাব্যে মুসলিম পুনর্জাগরণের স্বপে বিভোর কবিচিত্তের যে ব্যাকুল জিজ্ঞাসা উচ্চারিত তার স্বরূপ বিশ্লেষণ কর

মুসলিম পুনর্জাগরনের স্বপ্ন ফররুখ আহমদের
বাংলা সাহিত্য



অবতরণিকাঃ
ফররুখ আহমদ (১৯১৮-৭৪) বাংলা সাহিত্যের একজন মৌলিক প্রতিভাধর শক্তিমান কবি। বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে কাব্য-ক্ষেত্রে তার বর্ণাঢ্য আবির্ভাব। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'সাত সাগরের মাঝি' প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ সালে।এটি তাঁর সর্বাধিক আলোচিত ও সর্বাধিক জনপ্রিয় গ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থ টি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে কাব্যামোদী মহলে বিপুল সাড়া পড়ে যায়।কাব্যটি উৎসর্গ করা হয়েছে উপ-মহাদেশের খ্যাতিমান দার্শনিক কবি ইকবালকে।
'সাত সাগরের মাঝি' কাব্যগ্রন্থটি মুসলমানদের অতীত ইসলামি ঐতিহ্য ও জীবনাদর্শের অন্যতম দলীল।কবি এ কবিতার সর্বত্র মুসলমানদের অতীত ও ঐতিহ্য তুলে ধরে বর্তমান প্রজন্মকে আধার কাটিয়ে উঠার স্বপ্ন দেখিয়েছেন।কবি এ কথা ও বলেছেন যে নতুন এই পথে অনেক বাঁধা-বিপত্তি রয়েছে।তবুও কবি আশা করেছেন মুসলিম জাতি তাদের পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে।যথার্থ কাব্যপন্থানুসারে আশাবাদী মনোভাবই এ কাব্যে কবির জন্য এনে দিয়েছিল শিল্পসার্থকতা।

মুসলিম পুনর্জাগরণের স্বপ্নঃ
'সাত সাগরের মাঝি' কাব্যগ্রন্থের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ সালের শেষের দিকে।সে কল্লোল মুখরিত জীবনাঙ্গনে 'সাত সাগরের মাঝি' নিয়ে এসেছিল সমকালীন মুসলমানের আশা-আকাঙ্ক্ষা স্পন্দিত,ঐতিহ্য ভাস্বর,ভবিষ্যতের উজ্জ্বল আভাসে সমৃদ্ধ এক অপরূপ জীবন স্বপ্ন।নব-জাগ্রত আত্মপ্রতিষ্ঠাকামী মুসলমানের কাছে সে স্বপ্ন দেখা দিয়েছিল এক অপার আশ্বাসরূপে।
ফররুখ আহমদ রোমান্টিক মনোবৃত্তির বশে ইসলামের অতীত গৌরব ও ঐশ্বর্যের রাজ্যে মানস ভ্রমণ করে স্থির বিশ্বাসে পৌঁছেছেন যে মুসলমানের অতীত ঐশ্বর্য ও গৌরব সম্ভব হয়েছিল ইসলামি ধর্মাদর্শের প্রতি বিশ্বশততা ও বাস্তব জীবনে তাকে রূপায়িত করে তোলার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সাধনার ফলে সে আদর্শের প্রতি অবহেলা এবং তা থেকে বিচ্যুত হওয়ার ফলেই আধুনিক মুসলমানের জীবনে দুর্গতি নেমে এসেছে।অতএব জীবনে সে আদর্শের পুনঃসংস্থপনা ও অনুধ্যানেই রয়েছে মুসলমানের দুর্দশামুক্তির চাবিকাঠি।

'সাত সাগরের মাঝি' কাব্যের অধিকাংশ কবিতাই কবির ঐতিহ্য প্রীতি ও ইসলামি ধর্মাদর্শের মহত্ত্বে অকুণ্ঠ বিশ্বাস ও অনুরাগের পরিচয় পরিস্ফুট। এ ঐতিহ্য ও ধর্মাদর্শের আলোতে তিনি আধুনিক মুসলমানের জীবন-সমস্যা সমাধানের পথ যেমন খুঁজেছেন,তেমনি প্রাণের একটি অপরূপ সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্য পিপাসা নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছেন।

ভাব প্রকাশের পারস্পর্য লক্ষ্য করে কবিতাগুলোকে আমরা নিম্নরূপ শ্রেণিতে বিভক্ত করতে পারিঃ

  1. ক.অতীত যুগের মুসলমানের দুর্বার কর্মচঞ্চল প্রাণোচ্ছল জীবনের ঐশ্বর্যময় রূপ ফুটে উঠেছে কতগুলো কবিতায় যেমনঃসিন্দবাদ, বারদরিয়ায়, দরিয়ার শেষরাত্রি,বন্দরে সন্ধ্যা এই চারটি কবিতায় অতীত-বর্তমানের জীবন ভাবনার ও প্রকাশ ঘটেছে।
  2. খ। কতগুলো কবিতায় অতীত গৌরবের অধিকারী মুসলমানের শোচনীয় অধঃপতন ও তার কারণ যেমন নির্দেশিত হয়েছে,তেমনি তা থেকে উদ্ধার ও মুক্তির ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে-যেমনঃ আকাশ-নাবিক,স্বর্ণীগল,তুফান,এই সব রাত্রি,পাঞ্জেরি,পুরানো মাজারে এই ছয়টি কবিতা।
  3. গ।মুসলমানদের অধঃপতন ও বর্তমান দুর্দশার মূলে রয়েছে ইসলামের শ্রেয়ঃ ও কল্যাণের আদর্শ থেকে বিচ্যুতি এবং আত্মবিস্মৃতি । এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ হচ্ছে,জীবন পুনরায় ঐ আদর্শ অনুধ্যান ও অনুসরণ করে বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করে কর্তব্যের পথে এগিয়ে যাওয়া।এমনি একটি মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছেঃ হে নিশানবাহী,নিশান,নিশান বরদার,সাত সাগরের মাঝি এই চারটি কবিতায়।
  4. ঘ। কতগুলো কবিতায় কবির দৃষ্টি একেবারে বর্তমানের প্রতি নিবন্ধ।কবি মানুষের দুঃখ দুর্দশা সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন হয়ে উঠেছেন।এ দুঃখ দুর্দশার মূলে প্রত্যক্ষ করেছেন আধুনিক জড়বাদী সভ্যতার অভিশাপকে ।এ পর্যায়ের দুটি কবিতা-লাশ ও আউলাদ।
  5. ঙ।ঐতিহ্যের পরিমন্ডলে থেকেই কবি প্রেমের রোমান্টিক স্বপ্ন কল্পনার অপরূপ প্রকাশ ঘটিয়েছেন শাহরিয়ার ও ঝরোকায় কবিতা দুটিতে।
  6. চ।রোমান্টিক কবিচিত্তের মুক্তি-ব্যাকুলতা,অপূর্ণতার বেদনা,অপরিতৃপ্তির সুর অপরূপভাবে প্রকাশ পেয়েছে ডাহুক কবিতায়।


প্রথম পর্যায়ের কবিতাগুলোর মধ্যে 'সিন্দবাদ', 'বারদরিয়ার', 'দরিয়ার শেষ রাত্রি', এ তিনটি কবিতা মূলত একই ভাব ও কল্পনার।কবিতা তিনটির ভাব-উদ্দীপক শক্তি হচ্ছে আরব্য উপন্যাসের কল্পকাহিনীর অন্যতম নায়ক সিন্দবাদ। আরব্য উপন্যাসের সিন্দবাদের সমুদ্র সফরের যে রোমাঞ্চকর কাহিনী বর্ণিত হয়েছে,তাই কবি-কল্পনাকে উদ্দীপিত করেছে।এখানে সিন্দবাদকে কবি অতীত গৌরব-যুগের কর্মচঞ্চল,প্রাণোচ্ছল,দুঃসাহসী ও প্রত্যয়দৃপ্ত বিশ্ব-বিজয়ী  মুসলিম জাতির প্রতীকরূপে উপস্থিত করেছেন।সিন্দবাদ কাহিনীর প্রতীকী আধারে তিনটি কবিতায় কবি মুসলমানদের অতীত গৌরবময় দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদেরকে আত্ম-শক্তিতে বলীয়ান ও নবজাগরণের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।কবি যে নোনা দরিয়ার ডাক শুনতে পেয়েছেন তা তিনি সমগ্র মুসলিম জাতির প্রাণ-মূলে ছড়িয়ে দিতে চান সিন্দবাদের মতই দুর্দমনীয় প্রাণাবেগে চঞ্চল হয়ে নতুন পানিতে নতুন জীবনের অভিযাত্রায় মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে চান।তাই কবি বলেছেনঃ
কেটেছে রঙিন মখমল দিন,নতুন সফর আজ,
শুনছি আবার নোনা দরিয়ার ডাক,
ভাসে জোরওয়ার মউজের শিরে সফেদ চাঁদির তাজ,
পাহাড়-বুলন্দ ঢেউ বয়ে আনে নোনা দরিয়ার ডাক;
নতুন পানিতে সফর এবার,হে মাঝি সিন্দবাদ!

কবি যেন আবার অতীতের স্মৃতি ফিরে পেয়েছেন।কবির কল্পনায় অতীতের স্বপ্নময় জগৎ কত জীবন্ত হয়ে উঠেছে; অতীত যেন বাস্তবের প্রেক্ষিতে এসে বর্ণাঢ্য সজীব রূপ পরিগ্রহ করেছে।অতীতের স্বপ্ন কল্পনার জগৎকে বাস্তবের রূপরেখায় ফুটিয়ে তুলে কবি মুহূর্তে সুদূরচারী হয়ে গেছেন।সিন্দবাদের রূপকে কবি মুসলিম জাতির ইতিহাস আলোচনা করেছেন;আকীক বিছানো,রঙিন মখমল দিনের প্রত্যাশায় নতুন পানিতে সিন্দবাদের আবার নতুন অভিযাত্রা শুরু হবে।এ যাত্রায় বাধাবিপত্তি আছে 'রোষে ফুলে ওঠা কালাপানি' 'সুবিশাল আজদাহার' মত দন্ত বিস্তার করে তার 'শ্বেত কিশতীকে' গলাধঃকরণ করে ফেলতে পারে-কিন্তু সিন্দবাদ কোন বাধাতেই ভীত-সন্ত্রস্ত নয়।নীল দরিয়ার ডাক শুনে সে 'মাল্লার নীল বেশ' পরিধান করে 'নওল উষার' সফেদ রশ্মিধারার দিকে ছুটে চলেছে।তার চোখে মুখে নতুন জীবনের সুরভিত দিনের রঙিন স্বপ্নের দোলা।তাই কোন বাঁঢাই আজ তাকে প্রতিহত করতে পারবে না; কারণ সে নির্ভীক ,জংগী জোয়ান-'নতুন জীবনের তাজা ঘ্রাণ' তাকে মাতাল করে তুলেছে।

নতুন পথে অনেক বাধাবিপত্তি রয়েছে।সে কথা স্মরণ করে মাঝি-মাল্লাদের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়,আয়েশি রাতের আরাম-আয়েশের কথা মনে করে তাদের মধ্যে আফসোস হয়।কিন্তু হতাশা ও ব্যর্থতার মধ্যে নতুন জীবনের স্বপ্ন-কল্পনা বিকশিত হয় না।জীবনকে সার্থকতায় পূর্ণ করে তুলতে সবসময় কষ্ট ও ঝুঁকি নিয়ে দুঃসাহসিক অভিযানে বেরিয়ে পড়তে হয়।অদম্য সাহস,সুদৃঢ় প্রত্যয় ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই বিজয় ছিনিয়ে আনতে হয়।তাই কবির অন্তরের সাধ সিন্দবাদের মুখ দিয়ে নিঃসৃত হয়ঃ
ভেঙে ফেলো আজ খাকের মমতা আকাশে উঠেছে চাঁদ,
দরিয়ার বুকে দামাল জোয়ার ভাঙছে বালুর বাঁধ,
ছিঁড়ে ফেলে আজ আয়েশি রাতের মখমল-অবসাদ,
নতুন পানিতে হাল খুলে দাও,হে মাঝি সিন্দবাদ।

'বা'র দরিয়ায়' কবি অতীত যুগের মুসলমানদের সমুদ্র-যাত্রার দুর্বার,দুঃসাহসিক বর্ণনা দিয়েছেন।ঝড়,ঢেউ,ঘূর্ণাবর্ত,মৃত্যুর করালগ্রাস কোন কিছুই তাদেরকে সীমাহীন সমুদ্রের সুদূরে দুর্বার অভিযানে বেড়িয়ে পড়া থেকে বিরত করতে পারেনি।জীবনের অগ্রযাত্রায় অতীত যুগের মুসলমানেরা কালাপানির ভয়-বাঁধাকে উপেক্ষা করে নিশ্চিতভাবে তাদের লক্ষ্যস্থলে উপনীত হয়েছে।দেশ-দেশান্তর থেকে বিপুল সম্পদ আহরণ করে ঘরে ফিরেছে তারা; কখনো হয়তো বা সমুদ্র পথেই প্রাণ হারিয়েছে অনেকে।তবু ভয়,বাধা কাকে বলে তারা জানত না।কিন্তু বর্তমানে আর এই প্রজন্মের সাহস নেই,কর্মস্পৃহা নেই।আজ সে জড়তায় ক্লিষ্ট,পান্ডুর হয়েছে তার জীবনের রঙ।
কেটেছে পল্কা নরম আয়েশ আশরতে বহুদিন,
মর্চে ধরেছে কবজায়;ম্লান তাজ।

পরিশেষে বলা যায় যে,ফররুখ আহমদের 'সাত সাগরের মাঝি' কাব্যে অতীতকে নবমূল্যে উদ্ভাসিত করে ভবিষ্যতের পথ নির্দেশ দানের প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।তিনি তাঁর কাব্যে মুসলমান সমাজের জন্য একটি গৌরবময়,উজ্জ্বল ভবিষ্যতেরই স্বপ্ন দেখেছেন।

কোন মন্তব্য নেই

enot-poloskun থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.