ডাহুক কবিতায় কবি মানব জীবনের যে বেদনার রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন তা বর্ণনা কর

ডাহুক কবিতায় কবি মানব জীবনের যে বেদনার রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন তা বর্ণনা কর

সাত সাগরের মাঝি ,ডাহুক কবিতা
বাংলা সাহিত্য


উপস্থাপনাঃ

"সাত সাগরের মাঝি" (১৯৪৪) কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত 'ডাহুক' কবিতাটি ফররুখ আহমদের (১৯১৮-১৯৭৪) একটি সুবিখ্যাত কবিতা।সমগ্র বাংলা সাহিত্যের পটভূমিতেও এটি একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা।এখানে রোমান্টিক কবি চিত্তের সুতীব্র বেদনাবোধ এক অপূর্ব ব্যঞ্জনা ও আবেগময়তায় অভিব্যক্ত হয়েছে।পল্লী-বাংলার অতি পরিচিত ডাহুক পাখি এখানে কবি-আত্মার প্রতীক হয়ে উঠেছে।নিস্তব্ধ রাত্রির বুকে তৃষাদীর্ণ ডাহুকের ডাকে কবি নিজের মনেরই অতৃপ্ত সাধক আত্মার প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছেন।রাত্রির অন্ধকারে ঘুমন্ত পৃথিবীতে নিঃসঙ্গ কবি-মন অতৃপ্ত বেদনায় ভারাক্রান্ত অথবা মহান স্রষ্টার ধ্যানে নিবিষ্ট,নিমগ্ন।এমন সময় অন্ধকার রাত্রির স্তব্ধতা ভঙ্গ করে গভীর অরণ্য থেকে ডাহুকের ডাক চকিতে কবির চিত্তকে উদ্ভ্রান্ত করে দেয়।কবি-চিত্তের অবস্থা ডাহুকের সুর-তাল-লয়,কাল ও পরিবেশের সাথে মিশে যে করুণ ব্যথাদীর্ণ অপরূপ ব্যঞ্জনা লাভ করেছে তা আমাদের হৃদয়ের অনুভূতিতে প্রবলভাবে দোলা দেয়।হৃদয় মথিত সে দোলা ধ্যান-মগ্ন সাধকের চিত্তকে উদ্ভ্রান্ত করে তোলে।

ডাহুক সম্পর্কে ড. সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়ের মন্তব্যটি হচ্ছেঃ

ডাহুক বাংলা সাহিত্যের 'স্কাইলার্ক' । কবিতাটিতে রোমান্টিক কবি চিত্তের মুক্তি,ব্যাকুলতা,অপূর্ণতার বেদনা ও অপরিতৃপ্তির সুর অপরূপ কাব্যিক প্রকাশ লাভ করেছে।স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় ভারাক্রান্ত কবি চিত্তেরই আর্তনাদ যেন ভাষা পেয়েছে 'ডাহুক' কবিতায়।স্বপ্ন ও বাস্তবের দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত প্রকাশ ব্যাকুল কবি আত্মার সুতীব্র বেদনাবোধ কবিতাটির সর্বত্র লক্ষ্য করা যায়।সমস্ত কবিতাটির মধ্য দিয়ে কবি আত্মাই যেন কথা কয়ে উঠেছে।কবিতাটি তাই অপূর্ব রসঘন ও ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে উঠেছে।


কবির মানসচেতনাঃ
ফররুখ আহমদ মুসলিম পুনরুজ্জীবনবাদী কবি।ইসলামের আদর্শ এবং আরব ইরানের ঐতিহ্য তাঁর কবিতায় উজ্জ্বলভাবে প্রস্ফুটিত।ইসলামের মহান আদর্শের মধ্যেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন মানবতার মুক্তির সোপান। ইহলৌকিক ও পরলৌকিক কল্যাণের জন্য তিনি একমাত্র স্রষ্টার সন্তুষ্টির উপর নির্ভর করেছেন।প্রেম ও রোমান্টিকতার কবি ফররুখ আহমদের চেতনালোকে সবসময় ছিল এক অদৃশ্য শক্তির প্রতি আসক্তি।

'ডাহুক" কবিতায় কবিসত্তার প্রকাশঃ

ডাহুক কবিতায় কবির অতৃপ্ত বেদনাদীর্ণ কবিসত্তার প্রকাশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।ইসলামি ভাবাদর্শে আবদ্ধ কবি 'ডাহুক' কবিতার মাধ্যমে পৌঁছেছেন এক নির্জাগতিক চেতনায়।কবি জৈবিকতার বন্দধন ছিন্ন করে আত্মশুদ্ধি ও আত্মনুশীলনের মাধ্যমে পরম প্রভুর সান্নিধ্য লাভের ব্যাকুল ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন 'ডাহুক' কবিতায়।সাধারণ মানুষ সীমাবদ্ধ জড় পৃথিবীটাকেই সবকিছু মনে করে এর মাঝেই নিজেকে হারিয়ে দেয়,ভোগ বিলাসে লিপ্ত হয়।কিন্তু সাধকের আত্মা জড়তার ক্ষুদ্র আবেষ্টনীতে নিজেকে বন্দি হতে দেয় না।কবি বলেছেন-

ঘুমের নিবিড় বনে সেই শুধু সজাগ প্রহরী
চেতনার পথ ধরে চলিয়াছে তার স্বপ্ন পরী


আত্মমুক্তির প্রেরণাঃ 

 ডাহুকের স্তব্ধবিদারী ডাক কবি চেতনায় বয়ে নিয়ে আসে মুক্তির বার্তা।ডাহুকের ডাক শুনে কবি যেন তাই এক অনাবিল আনন্দ ও স্বস্তি খুঁজে পান।কবির মনের সমস্ত অতৃপ্তি দূর হয়ে যায়,কেননা 'রাত্রির অরণ্যতটে' সে 'অশ্রান্ত পাখির' ডাক 'অবাধ মুক্তির মত' মনে হয়।সারা অন্তর দিয়ে কবি যে মুক্তির সাধনা করেছেন,সে মুক্তির সন্ধান অবশেষে পাখির সুরের মধ্যে উপলব্ধি করে কবির অন্তরের সীমাহীন অতৃপ্তি যেন অনেকটা বিদূরিত হয়েছে।ডাহুকের ডাকে কবি খুঁজে পান অসীম স্রষ্টার মুক্তির আহ্বান।কবি বলেছেন-
ক্রমাগত ভেসে ভেসে পালক মেঘের অন্তরালে
অশান্ত ডুবুরি যেন ক্রমাগত ডুব দিয়ে তোলে
স্বপ্নের প্রবাল


অধ্যাত্ম চেতনার প্রকাশঃ 

বস্তুজগতের অন্তরালে মানবমনে সবসময় খেলা করে যায় নির্জাগতিক চেতনা।সবকিছু থেকেও কি যেন না থাকার অনুভূতি,সবকিছু পেয়েও না পাওয়ার এক গভীর অতৃপ্তিবোধ মানবাত্মাকে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে ।সে আশ্রয় খোঁজে মহান কোনো সত্তার মাঝে।ডাহুকের সুর কবির কাছে তেমনি মহান মুক্তির বাণী হিসেবে দেখা দিয়েছে।অধ্যাপক সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছেন-
স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনায় ভারাক্রান্ত কবি চিত্তের আর্তনাদ যেন ভাষা পেয়েছে ডাহুক কবিতায়।স্বপ্ন ও বাস্তবের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত প্রকাশ ব্যাকুল কবি আত্মায়ই যেন কথা বলে উঠেছে।

চেনা অচেনার দ্বন্দ্বঃ 

ডাহুকের ডাককে কবি অশরীরী সুর বলে মনে করেন,কিন্তু পরক্ষণেই তিনি অনুভব করেন-সে তো নিজে কোন সুর নয়,সুর-যন্ত্র মাত্র।তার সুরের সাধনা তার স্রষ্টার ইচ্ছাতেই  সম্পন্ন হয়।সাধকের আত্মা ও ঠিক তেমনি।সে আত্মা যে অতৃপ্তির বেদনায় ক্রন্দন করে,সে তা তার নিজের তাগিদে নয়-অদৃশ্যলোকের অনন্ত সত্তার অমোঘ ইঙ্গিতই তাকে উদভ্রান্ত,চঞ্চল করে তোলে।তাই ডাহুক পাখির মধ্যে কবি তাঁর অতৃপ্ত আত্মার সন্ধান করেনঃ

হে পাখি! হে সূরাপাত্র! আজও আমি

চিনিনি তোমাকে


কবির অনুভূতিঃ

অন্ধকারে নিমজ্জিত দুর্দশাগ্রস্ত জাতির অবস্থা দেখে কবি হৃদয় বিদীর্ণ হয়েছে।কবি দেশ জাতি ও আদর্শের মুক্তি নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছিলেন বাস্তবজীবনে তা রূপায়িত হয়নি।পাশাপাশি তিনি অন্তর্ধ্যানে পরমস্রষ্টার সান্নিধ্য কামনা করেছিলেন তাও জৈবিকতার দংশনে ফলবতী হতে পারেনি।কবি অনুভব করেন,তিনি যে জীবনে শিকল পরে আছেন তাতে পরমাত্মার সন্ধান লাভ করা তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব।তিনি তখন ডাহুকের উদ্দেশ্য বলে উঠেন-

শুনিয়া তোমার সুর,নিজেদেরি বিষাক্ত ছোবলে
তনুমন করি যে আহত।


উপসংহার ঃ

পরিশেষে বলা যায় যে,ডাহুকের অনুষঙ্গে কবির হৃদয়ের এক চরম অতৃপ্তি ফুটে উঠেছে।




কোন মন্তব্য নেই

enot-poloskun থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.