রাত্রিশেষ কবিতাটির বিষয় ও শিল্পরূপ বিশ্লেষণ কর
রাত্রিশেষ কবিতাটির বিষয় ও শিল্পরূপ বিশ্লেষণ কর
বাংলা সাহিত্য |
অবতরণিকাঃ
কবি ও সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতমান আহসান হাবীব (১৯১৭-১৯৮৫) তাঁর কবিতায় 'সামাজিক বাস্তবতা,মধ্যবিত্ত মানুষের সংগ্রামী চেতনা ও সমকালীন যুগযন্ত্রণা' শিল্প সম্মতভাবে রূপায়িত করে গেছেন।আধুনিকতার ছাপ তাঁর কবিতায় খুব স্পষ্ট হয়ে প্রকাশ পেয়েছে।কবিতার বিষয় নির্বাচনে ও আঙ্গিকগত রূপায়ণে তিনি বাংলা কবিতায় আধুনিকতার ঐতিহ্য অনুসরণ করেছেন।তিনি তাঁর কবিতায় দেশ কাল সমাজ ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন।তিনি ছিলেন আমাদের কবিতা শিল্প ভুবনের অগ্রযাত্রার পথিকৃৎ।যিনি অতি সচেতন ভাবে পাশাত্য আধুনিকতাকে চেতনাইয় ধারণ ও বোধে লালন করে সৃষ্টিযজ্ঞে দীর্ঘকাল স্তম্ভের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছেন।উত্তরাধিকার হিসেবে তিনি ত্রিশোত্তরের।কাব্য-ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে আহসান হাবীবের কবি জীবনের সূচনা।এই উত্তরাধিকার বোধের অনিবার্য প্রতিক্রিয়া তাঁর প্রথম জীবনের কবিতায় একটা সমন্বয়ী শিল্পবিশ্বাসের কার্যকারণ হয়ে ওঠে।যার ফলে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ রাত্রিশেষ এ ১৯৪৭, কলকাতা তিরিশোত্তর কাব্যধারার স্পন্দন যেমন সুস্পষ্ট, তেমনি,নবতর স্বপ্ননির্মাণের আকুলতা ও বিদ্যমান। কবিতার ভেতরেই চিরায়তরূপে স্বভাবগত স্বরটি অনুরণন প্রাঞ্জল্যে ভরপুর,ভাষা ও ছন্দ নতুন অর্থে কান্তিময়।রাত্রিশেষ কাব্যে সর্বপ্রথম একজন মুসলমান কবি ব্যাপক বিংশ শতকী চেতনাসহ আত্মপ্রকাশ করেন।
রাত্রিশেষ কাব্যের বিষয়-বিন্যাস
রাত্রিশেষ (১৯৪৭) কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যে যৌবনের মোহমুগ্ধতা, প্রেম-ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষা রূপায়িত হয়ে উঠেছে। কবি যন্ত্রসভ্যতার নৈরাজ্য ও হৃদয়হীনতায় ব্যথিত হয়ে পরিবেশের পরিবর্তন কামনা করেছেন।কবি আশা করেছেন শিশুরা আবার হাসবে, ক্ষুধা থেকে মানুষ মুক্তি পাবে, মানুষ হয়ে উঠবে প্রাণবন্ত হৃদয়বান। দেশবিভাগ মানুষের জন্য সুখী ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি বয়ে আনবে। কাব্যের রাত্রিশেষ নামকরণে সে ইঙ্গিতই ফুটে উঠেছে। কবি বলেছেনঃ
ঝরা পালকের ধ্বংস স্তুপে তবু বাঁধলাম নীড়,তবু বার বার সবুজ পাতার স্বপ্নেরা করে ভীড়,তবু প্রত্যহ পীত অরণ্যে শেষ সূর্যের কণা,মনে গহনে আনে বার বার রঙের প্রবঞ্চনা।[এই মন-এই মৃত্তিকা]
তিরিশোত্তর কাব্য-প্রবাহের সাথে আহসান হাবীবের তারুণ্যের উদ্দাম সময়গুলো সম্পর্কিত,সেজন্য এর প্রভাবকেও পুরোপুরি অতিক্রম করা তার অসাধ্য ছিলো কিন্তু হতাশা এবং বিমর্ষতার পরিবর্তে তিনি ক্ষোভ এবং জিজ্ঞাসাকেই প্রাধান্য দেন কবিতায়।সমকালের সমাজ বাস্তবতার সাথে কাব্য-ঐতিহ্যের সমীকরণ ঘটিয়ে বিস্ময়কর ভাবে,অনাগত সময়ের সূক্ষ্ম স্বপ্নের ও ইঙ্গিত দেন কখনো কখনোঃ
ভাষা-বিচারঃ
'সময়ের স্বর্ণ-ঈগল' কবি আহসান হাবীব শব্দ সম্পর্কে সচেতন। সে সচেতনতা প্রকাশ পেয়েছে পরিচিত শব্দের সার্থক ব্যবহারে। বাংলা কবিতার ভাষা প্রথম থেকে লোক মুখের ভাষা। এই লোকমুখের ভাষা আহসান হাবীবের কবিতা কে একদিকে যেমন বিশিষ্টতা দিয়েছে অপরদিকে তেমনি সমাজবাস্তবতার নিঁখুত চিত্র প্রতিফলিত হয়ে উঠেছে।রাত্রিশেষ কাব্যগ্রন্থের ভাষায় রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সমর সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবি ভাষার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মোর,নয়ন, পাখি, আজি,স্বপন, পানে, গগনতলে, বাতায়ন রবীন্দ্র-নজরুলের কাব্যভাষার ইত্যাদি একক যখন বাতিল হয়ে যাচ্ছে তখনও তিনি ব্যবহার করেছেন এগুলো। তবে এ কাব্যের মাঝামাঝি থেকে এ প্রবণতা স্তিমিত হয়ে এসেছে এবং কথা ভাষার প্রয়োগে কবিতা সমকালীন ভাষারুচীর অনুগামী হয়ে উঠেছে কিন্তু অতিক্রম করতে পারেনি।এসবের মধ্যেও পূর্বসূরি ও সমকালীন কবিতা ভাষার সংমিশ্রণে নতুন একটা ভাষা সৃষ্টির সংগ্রাম স্পষ্ট হয়ে ওঠে।যেমন-
ক)দিনগুলি মোর বিকলপক্ষ পাখির মতোবন্ধ্যা মাটির ক্ষীণ বিন্দুতে ঘূর্ণ্যমান।অন্ধ নয়নে দিনের কামনা আজিও উর্ধ্বায়িতমনের অশ্ব হ্রস্ব চণ বঞ্চনা-বিক্ষত।
কনফেশান,রেড রোড,পার্ক,কিড স্ট্রিট,মার্কুইস লেন,কিউ,রোমান্টিক,স্কোয়ার,কোম্
তোমার হাসি দেখেছি ওয়েলিংটন স্কোয়ারেদেখেছি এসপ্লানেডের মোড়ে।
ছন্দঃ
আহসান হাবীবের কবিতা প্রধানত অক্ষরবৃত্ত ছন্দকেই অবলম্বন করে রচিত।কিন্তু যখন রোমান্টিক চপলতা বা আবেগের অবিশ্বাস্য তীব্রতা বুঝিয়েছেন তাঁর কবিতায় মাত্রাবৃত্ত বা স্বরবৃত্ত ছন্দ ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।অলংকার-ব্যবহারঃ
আহসান হাবীব 'রাত্রিশেষ' কাব্যকে অলংকার মন্ডিত করে তুলেছেন।এ কাব্য শরীরে যেসব অলংকারের পরিচয় পাওয়া যায় তার মধ্যে উপমা, অনুপ্রাস,সমাসোক্তি,উৎপ্রেক্ষা,উপমাঃ
- ক)দিনগুলো মোর বিকলপক্ষ পাখির মতো।
- খ)আজো দিগন্তে স্বপ্নের মতো ভারি অপরূপ কায়া।
- গ)কাশ্মিরী মেয়েটির চোখ দুটি সাপের মতন।
- ঘ)আমার আত্মার তৃষ্ণা অগ্নিপক্ষ বিহঙ্গের মত।
অনুপ্রাস
আমাদের রক্তে আছে পাদপিষ্ট রক্তের ছোঁয়াচ!
আমাদের অস্থি ঘিরে আছে এক নতুনের ছাঁচ।
সমাসোক্তি
- ক)বনেদী মনের ডানা মেলে কবুতর নাচছে।
- খ)অসংখ্য মমীর কান্না আমাদের মনের গুহায়।
উৎপ্রেক্ষা
ছ'বছর ছ'বছরের নয়।সহস্র বছর যেন ঝড় বয়ে গেছে।
চিত্রকল্পঃ
ঝরা পালকের ভস্মস্তূপে তবু বাঁধলাম নীড়,তবু বারবার সবুজ পাতার স্বপ্নেরা করে ভীড়।
রূপকঃ
কোন মন্তব্য নেই