"কবি আহসান হাবীব যেমন সমকালস্পর্শী তেমনি জীবনের সমগ্রতা স্পর্শকারী কবি।" আলোচনা কর

 কবি আহসান হাবীব যেমন সমকালস্পর্শী তেমনি জীবনের সমগ্রতা স্পর্শকারী কবি।" আলোচনা কর 

বাংলা সাহিত্যে হাবীবের রাত্রিশেষ
বাংলা সাহিত্য



জীবনবৈচিত্র্য ,তার সংঘর্ষ ও গতি,প্রত্যাশা ও অচরিতার্থতা,সংক্ষোভ ও যন্ত্রণা এবং সর্বোপরি তার সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনার সমন্বিত পরিচর্যায় বাংলাদেশের আধুনিক কবিতার চেতনাজগৎ নির্মিত।দুই বিশ্বযুদ্ধের মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা ও যন্ত্রণাবোধে আলোড়িত শিল্পঐতিহ্যের প্রাণস্পন্দন সেই চেতনালোকে সঞ্চার করেছে বিশ্বপ্রবাহের জীবন্মায় সংবেদ ও আততি।কিন্তু কলোনি অন্তর্গত স্রষ্টা মানস ঐতিহ্য পরম্পরায় তীব্র অভিঘাত সত্ত্বেও একটা স্বতন্ত্র ভূগোল বা মানচিত্র নির্মাণের আকাঙ্ক্ষায় ১৯৪৭ এর দেশবিভাগ কাল পর্যন্ত ছিল স্বপ্নচারী।তাই বিভাগোত্তরকালে স্বাভাবিকভাবেই বাংলা কবিতায় অন্তর্দ্বদ্ব প্রচ্ছন্ন হয়ে ওঠে।এতদসত্ত্বেও জনজীবনের বিচিত্র,জটিল ও বহুভঙ্গিম আবর্তসংঘর্ষ গতি ও সংগ্রামের অভিঘাতে বাংলাদেশের কবিতা ও হয়ে উঠেছে এই বস্তুস্বরূপের অনুষঙ্গী।তাই এ সময়ের বেশ কিছু কবির কাব্যরচনায় উন্মেষ ঘটেছিল সমাজ,কাল ওজীবনের সমগ্রতা অঙ্গিকারের মধ্য দিয়ে,প্রারম্ভিক সততায় তাঁদের মন মানস ছিল সজীব ও অকৃত্রিম-সমাজ ও সমাজলগ্ন প্রত্যাশা,অচরিতার্থতা বেদনাবোধ সর্বোপরি একটা সম্ভাবনাময় জীবন পটভূমি নির্মাণের লক্ষ্যে তাঁদের সৃজনীকল্পনা নতুন সমাজকাঠামোর অন্তর্গত স্বরূপ গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। এসব উদার মানবতাবাদী ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রশ্নে ঐকান্তিক কবির মধ্যে আহসান হাবীব (১৯১৭-৮৫) অন্যতম।


কবি আহসান হাবীব সমাজ ও জীবনকে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করতে সচেষ্ট হলেন।তিনি মধ্যবিত্তশ্রেণির সংকট,অবরোধের স্বরূপ অনুধাবনে সমর্থ হন।পঞ্চাশ-ষাটের দশকের অবরুদ্ধ সমাজজীবনের অনুভব তাঁকে যথেষ্ট সোচ্চার করেছে।আহসান হাবীব তাঁর 'রাত্রিশেষ' (১৯৪৭) কাব্যের সমাজ ও স্বকালনিষ্ঠাকে বিভাগপর্বতী পর্যায়ে নতুন কাব্যভাবনায় রূপান্তর করতে সচেষ্ট হলো।সামন্ত আভিজাত্যবোধের সাথে উদার মানবতাবাদী জীবন ও শিল্প-জিজ্ঞাসার প্রশ্নে ঐকান্তিক,নব্য-শৃঙ্খলিত সমাজজীবনের অন্তর্বেদনার উচ্চারণে আহসান হাবীব স্বকাল জনজীবনমগ্ন,ইতিহাস,ঐতিহ্য ও মৃত্তিকা সংলগ্ন।


ব্যক্তিমাত্রই স্বতন্ত্র সত্তার অধিকারী।চিন্তায়,মননে,কর্মে একে অন্যের চেয়ে ভিন্ন।শিল্প-সাহিত্য যেহেতু ব্যক্তির সৃষ্টি ,তাই সৃষ্টি কর্মে শিল্পী সাহিত্যিকদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রূপায়িত হয়ে থাকে।আহসান হাবীবের কবিতায় ও তাঁর স্বতন্ত্র চারিত্র্য প্রকাশিত হয়েছে অনিবার্যভাবে।কাব্য-ভাবনা ও রচনা কৌশলে তাঁর অসাধারণ কবি প্রতিবার সাক্ষর সুস্পষ্ট।তিরিশের কাব্য-আন্দোলনে আহসান হাবীব সুর মিলিয়েছেন অথচ স্বকীয়তা অটুট রাখার এক দৃঢ় কঠিন শর্তে স্থিতধী ছিলেন তিনি।তিনি নিজস্বতা রক্ষার প্রতিজ্ঞায় সীমাহীন সাহসী-

আমাকে বিশাল কোনো সমুদ্রের ঢেউ হতে বলো
হতে পারি যদি এই প্রতিশ্রুতি দিতে পারো 
সমুদ্রের ঢেউ
হারায় না সমুদ্রের গভীরে এবং 
ফিরে আসে শৈশবের নদীর আশ্রয়ে।


এ প্রত্যাশা আহসান হাবীব কে করে তুলেছে প্রবল আশাবাদী। একদিকে আপন সত্তায় স্বাতন্ত্র্য কামী চেতনা, অন্যদিকে যন্ত্রণাবিদ্ধ সভ্যতাকে অতিক্রমণের ইচ্ছা এ দুয়ের সম্মিলন তাঁর  আশাবাদ কে করেছে প্রাণময়।যন্ত্রণাক্লিষ্ট কাল পেরিয়ে উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত কল্পনায় তিনি দৃঢ় সংকল্প সংবদ্ধ।জড়তা ও পশ্চাৎমুখীতাকে তিনি সমর্থন করেননি।প্রশ্রয় দেন নি সংশয় বা দোলাচল মনোবৃত্তিকেও।তাই তাঁর উদাত্ত আহ্বান অগ্রগমণের প্রতি-

তোমার চারপাশে বড় অন্ধকার তাই
সামনে যাবো
আরও সামনে
সূর্যোদয়ে যাবো
ইতিহাস আয়োজিত সাজানো মেলার
আলোয় দাঁড়াবো।


সময়ের সন্তান 'যুগের একান্ত' নাগরিক আহসান হাবীব ঘৃণার সাঁকো পেরিয়ে প্রেম আর বিশ্বাসের আলো হাতে নিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছেন সম্মুখপানে। গভীর অন্ধকার পথে সচেতন পদক্ষেপে তিনি আলোর দরজায় পৌঁছুতে চেয়েছেন।শূন্য মাঠে কয়েকটি ধান ছড়িয়ে হাবীব ধরতে চেয়েছেন আশার পাখিকে। সুবর্ণ স্বপ্নের অন্ধকারে বিলীনপ্রায় সভ্যতাকে আলোর মিছিলে তুলে আনতে চেয়েছেন তিনি-

হাতে হাতে
সরাবো রাতের অন্ধকার, ভোর হবে
ফুটবে ফুল, দুটি একটি পাখির ডানায় শেষ ঘুম ঝরে যাবে হিজলের ডালে আদিম আবেগে দেখা দেবে ধানের মঞ্জুরী, সেই ধান
মুঠো মুঠো আমরা ছড়াবো সারা মাঠে সঙ্গে তার কিছু মেধা আর কিছু প্রতিভা ছড়াবো
অজস্র ফসলে যারা এইসব অমর আত্মাকে
অন্ন দেবে এবং বিশ্রাম দেবে রৌধ্র আর ছায়ার মিছিলে।



আশাবাদী চেতনায় তিনি লালন করেছেন তাঁর কাব্য জগতকে।স্বকাল এবং স্বদেশের চরম দুর্যোগময় মুহূর্তেও তিনি ছিলেন প্রবল আশাবাদী। চাপ চাপ অন্ধকার ধসে পড়ার পর আলোকিত দিগন্তের ইঙ্গিত দেখতে পেয়েছেন তিনি-

রাতের পাহাড় থেকে
খসে যাওয়া পাথরের মতো
অন্ধকার ধসে পড়ছে।
দুহাতে সরিয়ে তাকে নির্বিকার নিরুত্তাপ মন
এগোলো।
সকালবেলায় হাওয়ায় লাগবে জোর
পুরনো ধুলোরা এবার উড়বে।



আহসান হাবীবের প্রত্যাশায় কোন তাড়াহুড়ো নেই; নেই অধীর ব্যগ্রতা। ব্যক্তি জীবনে যেমন তিনি নির্বিবাদী নিরীহ সংসারী তেমনি সাহিত্য ভুবনে আশায় বুক বেঁধে দীর্ঘদিন প্রতীক্ষা করতেও তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত। তাই সেঞ্চুরি ফুলের চারা বাগানে লাগিয়ে এক নির্মোহ দুর্লভ ইঙ্গিত তিনি নির্মাণ করেন কবিতায়-যখন তিনি থাকবেন না চলে যাবেন মৃত্যুর কালো অন্ধকারে তখন দীর্ঘদিন পর এই সেঞ্চুরি ফুল ছড়াবে পরবর্তী প্রজন্মের অন্তরে অন্তরে। জাগাবে তাদের মনে বেঁচে থাকার অনন্ত প্রেরণা। কবি লেখেন-

কি জানেন,আমি যাবো, আপনিও যাবেন শিশু আর কিশোর-যুবক সন্তানেরা; আমাদের
রয়ে যাবে সেঞ্চুরির চারা
দীর্ঘদিন পরে জানি ফুল দেবে।
দীর্ঘদিন।



আহসান হাবীবের কবিতায় আশাবাদ এসেছে সমাজ ঘনিষ্ঠতাভথেকে। সমাজের পোড়খাওয়া মানুষ ও তাদের প্রাত্যহিক জীবনের সুখ-দুখঃ ও সংগ্রামের বিশ্বস্ত সাহসী সহচর হিসেবে তিনি বরাবরই অগ্রবর্তী।সমাজ জীবনের যাবতীয় ক্লিষ্ট তাকে তিনি আচ্ছাদিত করতে চেয়েছেন প্রত্যাশার আলোয়। তিনি অন্ধকার থেকে আলোয় এবং অবিশ্বাস থেকে বিশ্বাসে উত্তরণে আগ্রহী-

জানালা খুলে দাও
পর্দা তুলে দাও
দেখতে দাও আজ
ভোরের বাগানের
সারাটা বুক জুড়ে
নতুন কারুকাজ


যান্ত্রিক নাগরিক সভ্যতার নির্মমতার দেয়াল ডিঙ্গিয়ে আহসান হাবীব মানবিক সভ্যতা গড়ার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।সচেতন ব্যক্তিমাত্রেই জানেন, সভ্যতা গড়ার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন সভ্য মানুষ গড়ার তাগিদ।কেননা মানুষই সভ্যতার কারিগর ও ভোক্তা।আহসান হাবীব এ সত্য উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তো তিনি ঘোষণা করলেন-

"আমি একটা কারিগর চাই যার সেতু কিম্বা সড়ক
অথবা মিনার কিম্বা ইমারত গড়ার কৌশল
জানার সামান্য কিছু প্রয়োজন নেই,শুধু জানে
মানুষ গড়ার কাজ।



এই নতুন সমাজ-বাস্তবতা গড়ার কল্পনা তাঁর সত্তায় প্রোথিত।চিন্তায় প্রকাশে কোনো কৃত্রিমতা নেই।কারণ তিনি তো সমাজ ও সংস্কৃতির সমকালের সন্তান।এই সমাজের ঐতিহ্যেই তিনি শিকড়ায়িত।আগন্তুক ছিলেন না তিনি।এই মাটি,প্রকৃতি,নদী,গ্রাম,নগর তাঁর অস্তিত্বের সংগঠন প্রক্রিয়ার মূলীভূত প্রেরণা। তাঁর ভাবনায়-

আসমানের তারা সাক্ষী
সাক্ষী এই জমিনের ফুল,এই
নিশি রাইত বাঁশ্য বাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী
আমি কোন অভ্যাগত নই
খোদার কসম আমি ভিনদেশী পথিক নই
আমি কোন আগন্তুক নই।


আহসান হাবিব ছিলেন মনেপ্রাণে অভিজাত শিল্পী। অর্থনৈতিক সমস্যার টানাপোড়নে জীবন কাটলেও তিনি রুচিরা আভিজাত্যে আত্মমর্যাদাবোধ থেকে সরে দাঁড়াননি কখনো। দারিদ্র্যের তাড়নায় বাণিজ্যিকভাবে লিখতে দেখা যায় অনেক শিল্পী সাহিত্যিক কে। কিন্তু আহসান হাবিব দারিদ্র‍্যের তাড়নায় তাঁর  শিল্পীসত্তাকে বিকিয়ে দেননি। কবিতা
কে কবিতার কাছে নিয়ে যেতে তিনি দৃঢ় অঙ্গিকার বদ্ধ-


আজ আমি বলি,অহংকার করেই বলছি,পরাক্রান্ত ক্ষুধাকে
আমি কবিতার ওপর হুকুম চালাতে দেইনি।



আহসান হাবীব স্বতন্ত্রকামী শিল্পী।আপন ভুবন নির্মাণে তিনি সর্বদা থেকেছেন সচেষ্ট। এই সচেতনতার কারণে তাঁর কবিতা শিল্প মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়েছে। সুতরাং উপরের আলোচনা থেকে আমরা নিশ্চিত বলতে পারি, বাংলা কবিতার অস্থিরতা ও অনুভূতির অগভীরতা আর মতবাদের নির্দিষ্টতা পেরিয়ে আহসান হাবীব  কবিকর্মে,আবেগ,সৌন্দর্যে একান্তভাবে উত্তীর্ণ ও স্বকীয়তায় দীপ্ত। 

কোন মন্তব্য নেই

enot-poloskun থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.