হাসান হাফিজুর রহমানের "শোকার্ত তরবারি" কাব্যের শিল্পমূল্যের পরিচয় দাও

হাসান হাফিজুর রহমানের "শোকার্ত তরবারি" কাব্যের শিল্পমূল্যের পরিচয় দাও 

হাসান হাফিজুর রহমানের শোকার্ত তরবারির শিল্পমূল্য
বাংলা সাহিত্য



বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতির ধারায় প্রগতিশীল ও প্রতিবাদী জীবনচেতনার অন্যতম প্রবর্তক হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩)।  বাংলাদেশের বাংলা কবিতার ধারায় হাসান হাফিজুর রহমান যেমন একনিষ্ঠ কবি, ঠিক তেমনি ছিলেন তরুণ কবিদের পথদ্রষ্টা। তিনি নিজে বাংলা কবিতার ধারাকে যেমন বেগবান করেছেন,তেমনি নবীন কবিদের 'হয়ে ওঠা'র ক্ষেত্রে ছিলেন 'সহায়ক শক্তি'। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর বাঙালি যখন আত্মদ্বন্দে লিপ্ত তখনই বাং সাহিত্যের ধারায় আবির্ভাব ঘটে হাসান হাফিজুর রহমানের। মূলত এক দ্বন্দ্বময় জটিল সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে অবস্থান করেও তাঁর চেতনালোকে পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে স্বদেশ ও মানবতার প্রতি অপরিসীম উপলব্ধির শিল্পময় প্রকাশ।আত্মজিজ্ঞাসা ও সত্তাসন্ধানের সমগ্রতায় কবি জীবনের সূচনা থেকেই হাসান হাফিজুর রহমান স্বতন্ত্র। সমকালীন বাংলা কবিতার বিষয়-সংকটকে তিনি গভীরভাবে অনুধাবন করেছিলেন।
সময়,সমাজ ও জীবনের অন্তর্ভেদী অবলোকন শোকার্ত তরবারি (১৯৮২) কাব্যে তাঁর কবিস্বভাবের নতুন প্রান্ত উন্মোচন করেছে।শোকার্ত তরবারির দীর্ণ,ক্ষতবিক্ষত অন্তর্বিশ্ব ও লালন করেছে উত্তরণের সম্ভাবনা। আবার পূর্বতন কাব্যধারার সামাজিক মাত্রাকে সময়ের কষ্টিপাথরে নব-প্রক্রিয়ায় উপস্থাপন করেছেন কবি।


'শোকার্ত তরবারি' কাব্যের বিষয়-বিন্যাসঃ

'শোকার্ত তরবারি' কাব্যে কবির বস্তুবিশ্ব সংলগ্ন হয়েছে বৈশ্বিক চৈতন্যের সাথে সমাজ ও জীবনের বিচিত্র উৎসের সাথে।তাঁর এই সুতীক্ষ্ণ মর্মন্তুদ পর্যবেক্ষণ ও অন্বেষা সময়-অন্তর্গত স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নকে, আশা ও নৈরাশ্যকে, সংযুক্তি ও বিযুক্তিকে উন্মোচন করেছে।কবি জীবন ও শিল্প সম্পর্কে উপনীত হন এক নতুন বোধে।আগুন থেকে দূরে কবিতায় কবি বলেছেনঃ

আমার সর্বাঙ্গ পুড়ে গেছে
পিঠের ওপর শুধু এক বিন্দু মধুময় গুঞ্জন 
একবিন্দু অবশিষ্ট ললিত ধ্বনি
শব্দমালার এক খন্ড নিদাগ চাঁদ
তাই নিয়ে আমি যাচ্ছি
সংক্রান্ত জানি না,গন্তব্য জানি না,উদ্ধার জানি না
শুধু যেতে চাই
আগুন থেকে দূরে আগুন থেকে দূরে



'শোকার্ত তরবারি'র অধিকাংশ কবিতার অবয়বে কবির জীবনানুভ পরিণত হয়েছে এক বেদনাঘন কাব্যপংঙক্তিমালায়।কখনো দার্শনিক অভিজ্ঞানের মতো,কখনো বা জীবনের গহনে গভীর মর্মতলস্পর্শী,আবার কখনো কখনো আশা-নিরাশার তীব্র টানাপোড়েনের মধ্যেও সূক্ষ্ম স্বপ্নময়তার বিন্যাস তাঁর এই নবজীবনবেদকে স্বতন্ত্র শিল্পমূল্যে চিহ্নিত করেছে।ব্যক্তিগত বেদনার পাত্রে কবি জীবনের সমগ্রতাকে ধারণ করেছেন।কবির ব্যক্তিবিশ্বের যে ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত রূপ এ কাব্যে আমরা দেখতে পাই,তা সময় ও সমাজ-বাস্তবতাকে পরোক্ষভাবে তুলে ধরেছেন।কবি যেহেতু জীবনকে কেবল অস্থি-মাংস-মজ্জার গতিহীন জড় রূপ মনে করেন না,সেজন্য প্রতিকূল ও বিরুদ্ধ সময়ের অন্তরালে বসেও কবি লালন করেন প্রত্যাশা ও স্বপ্নের সম্ভাবনা।এ কাব্য থেকে কবি স্পষ্টতই জীবন সম্পর্কে নিরাসক্ত হতে শুরু করেন। কবি কখনো তার আবাস রচনা করেছেন মৃত্যুর র সরল দচেতন স্ফটিকের শবাধারে,আবার কখনো অনস্তিত্বের জটিল শূন্যতায়।এই আশ্চর্য নিরাসক্তি যে জীবন থেকে পলায়ন নয়,সমাজ সত্যেরই নিগূঢ় অঙ্গীকার থেকে সৃষ্টি-তার ইঙ্গিত ও কবিতায় ব্যঞ্জনাময় রূপ লাভ করেছে।অগ্নিগর্ভ বর্তমানের মধ্যবিন্দুতে দাঁড়িয়ে কবি ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকেন এবং প্রত্যক্ষ করেন হত্যা,ধর্ষণ,বঞ্চনা,প্রতারণা,ক্রোধ,হিংসা,লোভ ,নৃশংসতার প্রতিচ্ছবি।কবির ভাষায়-

হত্যা,ধর্ষণ, বঞ্চনা এবং প্রতারণা এবং ক্রোধ, ঘৃণা হিংসা এবং
লোভ এবং লোভ নৃশংসতা এবং নৃশংসতা
শব্দের এক-চতুর্থাংশ গ্রাস করে ফেলেছে,
আরেক ভাগের দিকেও এগিয়ে আসছে আগুন,
অন্ধ আত্মসর্বস্ব সর্বভুক
নিষ্ঠুর নিষ্প্রাণ সর্বনাশ সে আগুন
মাঝখানে আমার বুক


কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সুদীর্ঘ কাব্যসাধনার পটভূমিতে 'শোকার্ত তরবারি' কে সমন্বয়বিন্দু হিসেবে বিবেচনা করা যায়।সুগভীর জীবনদৃষ্টি, অবলোকনের আবিশ্ব বিস্তার, ইন্দ্রিয়বেদী সংবেদনশীলতা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার নেপথ্যে সঞ্চারণশীল অতীত উৎসের প্রাণ্ময় সমারোহ এবং সর্বোপরি ব্যক্তি ও স্মষ্টির ঐকান্তিক সংলগ্নতা-যা কবির সমস্ত ক্ষোভ, নৈরাশ্য ও যন্ত্রণার মধ্যেও জীবন্ত করে রাখে অফুরন্ত সম্ভাবনাকে।
জীবনের অনিবার্য ক্ষয়ক্ষতি  ও উত্তরণহীনতা সত্ত্বেও আত্মকেন্দ্রিকতাকে জীবনের জন্য পরম বলে গ্রহণ করেন না তিনি।বরং প্রতিক্রিয়ার চোরাবালির পরিবর্তে প্রগতির দ্বন্দ্বময় সত্যকেই অধিকতর আকর্ষণযোগ্য মনে করেন।স্মৃতি উৎস ও বর্তমানের বেদনার্ত ইতিহাস অনুধাবন সত্ত্বেও কবির জীবন পিপাসার নিবৃত্তি হয়না।কবিতার ভাষায়-

ভ্রাতৃরক্তে অনেক শ্যামলিয়া ধোয় হয়ে গেছে,
মাটির গেরুয়ায় অনেক মিশেছে মানুষের রঙ,
মৃত্যুর চিৎকারের চেয়েও ভয়াবহ বিলাপে বাতাস
বহুকাল ভারী হয়ে আছে,তবু কোন
সুস্বাদু জীবনের পিপাসায় আমি হাঁটু গেড়ে বসবো,
দু'হাত  ওপরে তুলবো মওসুমী ফসলের আরাধনায়।


সভ্যতা ও ইতিহাসের প্রথাবদ্ধ খোলাসের মধ্যেই কবি আবিষ্কার করেন মানবীয় অবক্ষয়ঃ

ইতিহাস যেন এক আপাদস্তক পোষাকের মতো
যেখানে ছুরির ঘায়ে আনাড়ীর কৌতূহল 
কেবলই খোঁজে রাজরাজড়ার দেহ।আমাদের মুক্তি
খোঁজে না কেউ। 


ভাষা-বিচার

'শোকার্ত তরবারি' কাব্যগ্রন্থের ভাষা বেশ সহজ-সরল; দুর্বোধ ও অপ্রচলিত তেমন কোন শব্দের ব্যবহার করেননি। ভাব প্রকাশের জন্য তিনি কবি প্রচলিত শব্দকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে কিছু কিছু শব্দ বা ভাষা প্রচলিত অর্থকে অতিক্রম করে রূপক বা প্রতীকধর্মিতায় আশ্রয় নিয়েছে। তবে তাঁর কাব্য ভাষার মধ্যে একটি বেদনাবহ সুর প্রবহমান। যেমনঃ

বনভূমি পেরিয়ে যখন ইচ্ছে হয়,সুগন্ধমাতালা
মহুয়ার কাছে যাই, পায়ের নিচে মরা পাতার কান্না
বুকের ভেতর এফোঁড়-ওফোঁড় করে, কান্না মাড়িয়ে যাব কি সাহসে উদ্যত ,
না,ফিরে যাবো ব্যাথায় বিব্রত,মথিত,হতশ্বাস?


তবে হাসান হাফিজুর রহমানের এ কাব্যে প্রচলিত শব্দের পাশাপাশি বিষয়ের স্পষ্টতার জন্য ইংরেজি শব্দও ব্যবহার করেছেন বেশ কিছু কবিতায়।যেমন-ব্যাকগিয়ার, পলিউশন, ড্রাইভ, টাই, হ্যাভারস্যাক, বস্ত্র সাফায়্যার, বাসস্টপ, স্টেনগান, টাইমবম্ব, স্কুটার প্রভৃতি।কবিতা থেকেঃ

সময়ের ভেতরে লুকানো টাইমবম্ব
অষ্টক্ষণ টিকটিক আওয়াজ করে চলেছে।


ছন্দ

হাসান হাফিজুর রহমানের 'শোকার্ত তরবারি' কাব্যের সবগুলো কবিতাতেই মূলত গদ্যছন্দ ব্যবহৃত হয়েছে। হয়তো ছন্দহীন জীবন সময় কে ফুটিয়ে তুলতে কবি গদ্যছন্দের আশ্রয় নিয়েছেন। যেমন-

গাঢ় খাদ,গূঢ় আসবাব, বাসি ফল,কাঁকরমেশানো
চাল ফ্রিজের গুমগুম নিবিড় আওয়াজ,ওষুধের
স্তব্ধশিশি,গুজব,গুম খবর,ওলটপালট রাজনীতি,
কয়েকটা অস্ত্রোপচারের উত্তেজনা কিংবা
রাস্তার মোড়ে ভাস্কর্য সরানোর ফিসফাস।



অলঙ্কার-ব্যবহার

হাসান হাফিজুর রহমান 'শোকার্ত তরবারি'  কাব্যকে অলঙ্কারমন্ডিত করে তুলেছেন। এ কাব্য-শরীরে যেসব অলঙ্কারের পরিচয় পাওয়া যায় তার মধ্যে উপমা,সমাসোক্তি,উৎপ্রেক্ষা,চিত্রকল্প অন্যতম। যেমনঃ

      উপমাঃ


ক)আমি বুঝি মরা নদীটির মতো।
খ)নির্ভেজাল দুধ ঘেঁটে তোলা খাঁটি ননীর মতো।
গ)কাফনের মতো সূর্যের শাদা রঙে
ভয়াল শূন্যতার ঝি ঝি রব।
ঘ)চন্দনের মতো চাঁদনির পেলব বুকে নিয়ে।


সমাসোক্তিঃ
ক)পায়ের নিচে মরাপাতার কান্না
বুকের ভেতর এ-ফোঁড় ও ফোঁড় করে।
খ)নিসর্গ দুপায়ে পথ নীরবে বাড়িয়ে দেয়।


উৎপ্রেক্ষাঃ
ক)সারারাত বৃষ্টিতে ভিজে মাটি কান্নায় কোমল হয়ে আছে,
কোথাও যেন বিশাল বেদনা ছিলো।
খ)স্বয়ং ঈশ্বর যেন বুকের ভেতরটা হাট করে খুলে দিয়েছিলেন।


চিত্রকল্প

অন্তর্মুখী জীবন সন্ধানের একাগ্রতা শোকার্ত তরবারি কাব্যের অধিকাংশ কবিতাকে করেছে অন্তরঙ্গ ধ্বনিব্যঞ্জনাসম্বলিত ও চিত্রকল্পময়।বর্ণনা ও চিত্রধর্মিতার ভূমিকা এখানে গৌণ।  বর্ণনার পরিবর্তে এসেছে বিশ্লেষণ, দৃশ্যচিত্রের পরিবর্তে প্রাধান্য অর্জন করেছে উপমান-উপমেয়ের বিমূর্ততাঃ

কোমল কাঁচা মাটিতে পা রেখে
আমার পাথরও কেঁদে বলে যেতে চায়, আমার
সমস্ত ভার নেমে যেতে চায় ।


সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে জীবনের অন্তঃসারকে আত্মস্থ করে কবি জন্ম দিয়েছেন কিছু অনবদ্য চিত্রকল্প।যেমনঃ

দূরাচার পিপাসাটাকে
দিগ্বলয়ের নগ্ন হাতে ছেড়ে দিয়েছিলাম,
যতদূর দেখার সাধ্য,সবুজ সবুজ সবুজ,
স্বয়ং ঈশ্বর যেন বুকের ভেতরটা হাট করে খুলে দিয়েছিলেন।



সুতরাং সার্বিক বিচারে বলা যায় যে,হাসান হাফিজুর রহমানের 'শোকার্ত তরবারি' কাব্যের দু একটি কবিতা ছাড়া বাকী কবিতাগুলি শিল্পসাফল্য। ভাষা-ছন্দ-অলঙ্কার সব মিলিয়ে শিল্পমূল্য রয়েছে এ কাব্যের।

কোন মন্তব্য নেই

enot-poloskun থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.