'বন্দী শিবির থেকে'কাব্যের "কবিতাগুচ্ছ একজন সন্ত্রস্ত,ব্যথিত কবির অভিজ্ঞতা ও ভাবনাবেদনাসার।" মন্তব্যের সপক্ষে তোমার বক্তব্য উপস্থাপন কর
বন্দী শিবির থেকে কাব্যের কবিতাগুচ্ছ একজন সন্ত্রস্ত ব্যথিত কবির অভিজ্ঞতা ও ভাবনাবেদনাসার মন্তব্যের সপক্ষে তোমার বক্তব্য উপস্থাপন কর
বাংলা সাহিত্য |
তুমি আসবে বলে,হে স্বাধীনতা
শহরের বুকে জলপায় রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মতো চিৎকার করতে করতে।
তুমি আসবে বলে,হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস,বস্তি উজাড় হলো।রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালে যত্রতত্র।
স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ ও আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে 'তোমাকে পাওয়ার জন্যে ,হে স্বাধীনতা' কবিতায়।এই কবিতায় একই সঙ্গে দেখিয়েছেন স্বাধীনতাপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় কীভাবে বাঙালি প্রহর গুণে এবং স্বাধীনতা যে আসবেই এই প্রত্যাশা দৃঢ়মূল ধরেই আত্মত্যাগের চালচিত্র। স্বাধীনতাকে পাবার জন্য এদেশের সাধারণ মানুষ থেকে ধরে সর্বশ্রেণির মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।সকনা বিবির মতো অনেক বাঙালি রমণীর কপালে দুঃখ ভোগের ছায়া নেমে এসেছে।হরিদাসীর মতো কত রমণীর সিঁথির সিঁদুর মুছে গেছে।দানবের মতো শহরের বুকে নেমেছে ট্যাঙ্ক।উজাড় হয়েছে বস্তি,ছাত্রাবাস,শহর বন্দর,ছাই হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম,অনেক অবুঝ শিশু তাদের পিতামাতার লাশের উপর হামাগুড়ি দিয়েছে।কবির ভাষায় বলা যায়ঃ
স্বাধীনতা তোমার জন্যে
রাইফেল কাঁধে বনে-জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে-
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে,হে স্বাধীনতা।
'বন্দি শিবির থেকে' কাব্যের কবিতায় সমগ্র বাংলার উপর পাকিস্তানি হায়নাদের যে অত্যাচার ,অবিচার, জুলুম,হত্যা,ধর্ষণ তা বিশ্বস্ত বাস্তবতায় অঙ্কিত হয়েছে।আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সামগ্রিক অত্যাচারের কাহিনিকে ধারণ করেছে এ কাব্যের বিভিন্ন কবিতা। এ কাব্যের অধিকাংশ কবিতা তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে বসে রচনা করেছেন।এ কাব্যের কবিতায় উঠে এলো- বাংলার বুকে পাকিস্তানি হানাদারদের নয় মাসের অবর্ণনীয় পাশবিকতা।পাকিস্তানি জল্লাদবাহিনী মানবতার কন্ঠকে স্তব্ধ করে মেতে উঠেছিল গণহত্যায়।লক্ষ লক্ষ বাঙালি শহিদ হয়েছেন তাদের পাশবিক হত্যাযজ্ঞে।ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর,শহর থেকে গ্রামে গঞ্জে-সমগ্র বাংলাদেশের জমিন তারা বাঙালির রক্তে রঞ্জিত করলো।
ট্রাকে করে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায় এদেশের নিরীহ যুবককে-বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে।মায়ের বুক থেকে কেড়ে নেয় যুবক ছেলেকে-সে আর ফিরে আসেনা।বাবার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় যুবতি কন্যাকে-তাকে ধর্ষন শেষে হত্যা করে ভাগাড়ে ফেলে দেয়।সমগ্র দেশটা তাদের দখলে-বাঙালিরা যেন এদেশে পরবাসী-কথা বলার অধিকার নেই।কবির ভাষায় বলা যায় যে,
আমরা তৃষিত হয়ে পড়েছিলাম এক ঝলক আলোর জন্যে।নীরান্ধ্র শ্বাসরোধকারী সেলের ভেতর বন্দী যেমন ব্যাকুল হয়ে থাকে একফোটা আলোর জন্যে,ঠিক তেমনি।
অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীকে শামসুর রহমান নরকবাস বলে অভিহিত করেছেন এবং কবিতার ছত্রে ছত্রে সেই নরকবাসের সময়টিকে বিম্বিত করেছেন বিভিন্ন চিত্রের মধ্য দিয়ে অবশ্য সেই নরকবাস থেকে মুক্তির স্বপ্ন ও প্রবল বেগ পেয়েছিল এটি সত্য-
কখনো নিঝুম পথে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে কেউ গুলির আঘাতে,মনে হয় ওরা গুলিবিদ্ধ করে স্বাধীনতাকেই।দিনদুপুরে জিপে একজন তুলে কানামাছি করেনিয়ে যায় ওরা;মনে হয় চোখ-বাঁধা স্বাধীনতা যাচ্ছে বধ্যভূমিতে।বেয়নেটবিদ্ধ লাশ বুড়িগঙ্গা কি শীতলক্ষ্যায় ভাসে;মনে হয়,স্বাধীনতা লখিন্দর ,যেন,বেহুলা বিহীন।
'কিছুই নেই' কবিতায় যুদ্ধের ভয়াবহতা নেই কিংবা যুদ্ধ সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো চিত্র নেই-তবে যুদ্ধজনিত কারণে কবির যে একাকিত্ব তা এ কবিতায় পাওয়া যায়।অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে কবি একা-তাঁর পরিজন বলতে তাঁর আশপাশে কেউ নেই।চারদিকে একটা চাপা উত্তেজনা,কেউ চলে যায় বাঁকা দৃষ্টি ছুড়ে।অর্থাৎ একটা আতঙ্ক বিরাজ করে সর্বক্ষণ কবির চারপাশ ঘিরে।এখনো চেনা মানুষের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ মেলে না।তাই কবি বলেছেনঃ
কী আছে আমার আজ?কিছুই নেই,শুধু
বিভারিক্ত ধু-ধু
পথপ্রান্তে আছি পড়ে,পরিত্যক্ত একা;
প্রার্থিত জনের দেখা
মেলে না কখনও।এমনকি কবিতাও
ফিরিয়ে নিয়েছে দৃষ্টি।
পালাচ্ছে শহর ছেড়ে দিগ্বিদিক।নবজাতককে
বুকে নিয়ে উদ্ভ্রান্ত জননী
বনপোড়া হরিণীর মতো যাচ্ছে ছুটে।
'তার উক্তি' একটি ব্যতিক্রমধর্মী কবিতা।এই কবিতায় কবি রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে পাকসৈন্য কর্তৃক নিহত এক বুদ্ধিজীবীর কঙ্কালের জবানিতে বিষয়-ভাবনা প্রকাশ ঘটিয়েছেন।বুদ্ধিজীবী মানুষটিকে কীভাবে তার করুণ পরিণতি বরণ করে নিতে হয়েছে তার বর্ণনাও কবি দিয়েছেনঃ
আর এই শূন্য জায়গাটায়
স্পন্দিত হৃৎপিন্ড ছিল,যা ওরা নিয়েছে উপড়ে পাশব আক্রোশে
আর এই মাত্র যেটা লোভাতুর কুকুর মেয়াল
পালালো সাবাড় করে
এ জন্যেই জীবনের বৈমাত্রেয় দ্বিপ্রহরে হলাম কংকাল।
কবি পাকহানাদার বাহিনীর বর্ণনাহীন নির্যাতনের সাথে সাথে পাকিস্তানি দালালদের নির্মমতাকেও প্রত্যক্ষ করেন।তাদের দ্বারা সৃষ্ট নির্যাতনের চিত্র কবি তুলে ধরেছেন 'প্রাত্যহিক' কবিতায়।কবি তাদের বর্বর বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যুদ্ধের বিকল্প কোনো পথ খুঁজে পাননি।কবি অফিসে যেতে আসতে প্রত্যক্ষ করেন যুদ্ধের ভয়াবহতা,পাঞ্জাবি সৈন্যদের নির্মমতা এবং পাকিস্তানি দোসরদের অমানবিকতা।তাই সামগ্রিক চিত্র দেখে কবি বলেছেনঃ
সত্যের বলাৎকার দেখে,নিরপরাধের হত্যা
দেখেও কিছুতে মুখ পারি না খুলতে।
বুটের তলায় পিষ্ট সারাদেশ,বেয়নেটবিদ্ধ
যাচ্ছে বয়ে রক্তস্রোত,কত যে মায়ের অশ্রুধারা।
'আন্তিগোনে' কবিতায় ও যুদ্ধের বিভীষিকাকে তুলে ধরেছেন 'আন্তিগোনের' সমান্তরালে।পাকসৈন্যদের নির্মমতা শহর পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে।প্রেত নগরী নগ্ন,ফাঁকা,রাস্তাঘাটে শুধুই মৃতদেহ ভাসছে,সান্ত্রী সেপাই পাহারা দিচ্ছে চারদিকে,নগর জোড়া ত্রাস।কবিতার ভাষায়ঃ
আন্তিগোনে দ্যাখো চেয়ে
একটি দুটি নয়কো মোটে,
হাজার হাজার মৃতদেহ
পথের ধূলায় ভীষণ লোটে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ছিল প্রত্যাশার একটি নাম 'গেরিলা'।গেরিলার সঠিক কোনো প্রতিকৃতি জানা ছিল না গ্রামের মানুষদের।তবুও তাদের বিশ্বাস ছিল গেরিলারাই তাদের দুঃখ তাড়াবে।কবিতার ভাষায়ঃ
দেখতে কেমন তুমি?কী রকম পোশাক-আশাক
পরে করে চলাফেরা?মাথায় আছে কী জটাজল?
সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি,দুঃখ তাড়ানিয়া
তুমি তো আমার ভাই,হে নতুন সন্তান আমার।
'সান্ধ্য আইন' কবিতায় কবি সান্ধ্য আইনে বন্দি ঢাকা শহরের অবরুদ্ধতার চিত্র এঁকেছেন। কবি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন একা।সেখানে দাঁড়ানো ও বিপদ।দুঃখরা আজ নিথর আঁধারে নীরব হয়ে আছে।শহরটাকে মনে হয় যেন মৃতের নগরী।মৃতেরা এবং গোরখোদকো একটা ভীষণ নকশায় নিশপ্রাণ হয়ে আছে।তাইতো কবি বলেছেন-
এ শহরে কি আজ কেউ নেই?কেউ নেই?
আশেপাশে আছে গাছ-গাছালির শোভা।
পাতার আড়ালে জ্বলছে সে কার চোখ?
শহীদ মুনীর চৌধুরীকে কেন্দ্র করে কবি রচনা করেছেন 'বন্দী শিবির থেকে' কাব্যের অন্তর্গত 'রক্তাক্ত প্রান্তরে' কবিতা।এ কবিতায় কবি একই সাথে মুনীর চৌধুরীর বিভিন্ন স্মৃতিকে তুলে ধরেছেন এবং মাঝে মাঝে যুদ্ধের বিভিন্ন প্রসঙ্গ ও টেনে এনেছেন।কবিতার ভাষায়-
ডাইনে অথবা বাঁইয়ে ,কোথাও পাচ্ছি না খুঁজে আজ।
আপনার গলার চিহ্নিত স্বর কেন
এ শহরে প্রকাশ্য উৎসবে
শুনতে পাবো না আর?সেই চেনা স্বর?
'মধুস্মৃতি' কবিতায় কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অবস্থিত মধুর ক্যান্টিনের মধুদার স্মৃতিকে তুলে এনেছেন।বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ২৫ মার্চ রাতে পাকসৈন্যরা মধুদাকে নির্মমভাবে হত্যা করে।কবিতার ভাষায়-
আপনি ছিলেন প্রিয়জন আমাদের
বড়ো অন্তরঙ্গ নানা ঘটনায়
উৎসব এবং দুর্বিপাকে।বুঝি তাই
আপনার রক্তে ওরা মিটিয়েছে তৃষ্ণা।
বিশ্বাস করুণ,
ভার্সিটি পাড়ায় গিয়ে আজও মধুদা মধুদা বলে খুব
ঘনিষ্ঠ ডাকতে সাধ হয়।
সুতরাং আমরা বলতে পারি পাকসৈন্যরা যুদ্ধের সময় সারাদেশে যে বিভীষিকাময় পরিবেশ তৈরি করেছিল তার পরিচয় আমরা শামসুর রহমানের 'বন্দী শিবির থেকে' কাব্যে পাই।'বন্দী শিবির থেকে' কাব্যের কবিতাগুচ্ছ একজন সন্ত্রস্ত ব্যথিত কবির অভিজ্ঞতা ও ভাবনাবেদনাসার।এ কাব্যে তিনি ঢাকা শহরের ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র তুলে ধরলেও তা ছি
কোন মন্তব্য নেই