সাদৃশ্য কি? সাদৃশ্যমূলক পরিবর্তন বলতে কী বুঝ? এর প্রভাবে ভাষার বিভিন্ন প্রকার পরিবর্তন এর পরিচয় দাও

 সাদৃশ্য কি? সাদৃশ্যমূলক পরিবর্তন বলতে কী বুঝ? এর প্রভাবে ভাষার বিভিন্ন প্রকার পরিবর্তন এর পরিচয় দাও

সাদৃশ্য কি? সাদৃশ্যমূলক পরিবর্তন বলতে কী বুঝ? এর প্রভাবে ভাষার বিভিন্ন প্রকার পরিবর্তন এর পরিচয় দাও,লোক নিরুক্তি


 

ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে রূপমূল এর গঠন ও অর্থ পরিবর্তনে সাদৃশ্যের বিশেষ গুরুত্ব বিদ্যমান। ভাষায় বিভিন্ন শ্রেনীর যে উপাদান ব্যবহৃত হয়, তা একে অন্যের পরিবর্তন বা অন্যের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। সেদিক থেকে বিচার করলে সাদৃশ্য এক ধরনের ভাষাতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ারূপে গ্রহন করা যায়,যার সাহায্যে এক বা একাধিক রূপমূল পরিবর্তিত হয়ে থাকে।সাদৃশ্যগত এই প্রক্রিয়া ভাষার গঠন প্রভাবান্বিত করে।সাদৃশ্য হলো এমন এক প্রক্রিয়া যার ফলে ভাষায় বিরাজমান কোন রূপমূল বা শব্দবিন্যাস এর প্রভাবে অন্য রূপমূল শব্দ বা বিন্যাস সৃষ্টি। এই প্রক্রিয়ায় ভাষায় কোন একটি রূপ আরেকটি রুপের মত হয়ে ওঠে। সাদৃশ্যের ফলে ভাষা থেকে অনেক  বিশৃঙ্খলা বা অনিয়ম লোপ পায়, তবে সাদৃশ্য ভাষায় নতুন কোনো ক্যাটাগরি সৃষ্টি করে না,শুধু বিরাজমান বস্তুর বিস্তার ঘটায়।নিচে সাদৃশ্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

 

সাদৃশ্যঃ


সাদৃশ্য, ধ্বনি পরিবর্তনের একটি মানসিক কারণ। কথা বলার সময় কোন ধ্বনিই বিচ্ছিন্নভাবে উচ্চারিত হয় না। বাক্যের সমগ্র অর্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে ধ্বনিগুচ্ছ উচ্চারিত হয়। বাক্যের মধ্যে অর্থ সম্বন্ধযুক্ত পদ পৃথকভাবে থাকে। প্রয়োজনবোধে সেই পদগুলির নতুন নতুন শব্দ তৈরি করা হয়। এভাবে অর্থযুক্ত পদের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করার জন্য পদের ধ্বনি বা অর্থ পরিবর্তন হওয়া কে বলা হয় সাদৃশ্য।

অন্যভাবে বলা যায় একাধিক ভিন্নাকার শব্দ যদি অন্য শব্দের আকার পায় তবে সেই ব্যাপার কে বলে সাদৃশ্য ।কখনো কখনো এর প্রভাবে অনেক শব্দ সুনির্দিষ্ট ধ্বনি পরিবর্তনের নিয়ম এড়িয়ে যায় ।  উদাহরণস্বরূপ বলা যায় বধূ শব্দের সঙ্গে ও স্ত্রীলিঙ্গে টিকা প্রত্যয় যুক্ত হলে হয় বধূটিকা > বহুড়ী > বউড়ি। ভাষা সাযুজ্য একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যপার। এর ফলেই একটি শব্দ অন্য শব্দের নৈকট্য লাভ করে, প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ঘটায় অথবা নতুন শব্দ সৃষ্টিতে সাহায্য  করে । দীনবন্ধু মিত্রের সধবার একাদশী নাটকে একজন ইংরেজি শিক্ষার্থী বলেছে পুরুষবাচক সর্বনাম গুলি যদি he,his,him হয় তবে স্ত্রীবাচক সর্বনামগুলি কেন she , shis, shim হবেনা?সাদৃশ্যের কাজ প্রধানত তিনটি- 


  • ক) পদের ধ্বনি পরিবর্তন,
  • খ) নতুন পদের সৃষ্টি,
  • গ) পদের অর্থ পরিবর্তন।


সাদৃশ্য হচ্ছে ভাষা গঠনের একটা অংশ থেকে ভাষাতাত্ত্বিক উপাদান একই গঠনের অন্য অংশে স্থানান্তরীকরণ প্রক্রিয়া। সাদৃশ্যের প্রভাবে ভাষায় ব্যবহৃত রূপমূলের অন্তর্বর্তী গঠন পরিবর্তিত হয় বলে এই শ্রেণীর পরিবর্তনকে অন্তর্বর্তী ঋণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় । তার কারণ, ভাষায় ব্যবহৃত একটা রূপমূল বা ভাষাতাত্ত্বিক উপাদানের প্রভাবে অন্য একটা উপাদানের পরিবর্তনের প্রথম উপাদানটি  দ্বিতীয় উপাদানের,  বা দ্বিতীয় উপাদানটি প্রথম উপাদানের অংশ বিশেষ দ্বারা প্রভাবান্বিত হলে তা ঋণ রূপে ধরা যেতে পারে। ঋণ অর্থে এখানে ভাষাতাত্ত্বিক একটা উপাদানের নিজস্ব কোন অংশ নয়, তা অন্যের একটা উপাদান থেকে ঋণ গ্রহণের সাহায্যে নিজের রুপের পরিবর্তন সাধন। সাদৃশ্যের  সাহায্যে ভাষাগত উপাদানের পরিবর্তনে কি কি শর্ত বা অবস্থা ক্রিয়াশীল থাকতে পারে , তা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করা কঠিন।

সাদৃশ্য কে বিশেষ ধরনের ধ্বনি পরিবর্তন রূপে চিহ্নিত করা যায়। ভাষার ক্ষেত্রে সাদৃশ্যগত পরিবর্তন বলতে বোঝায় অন্য শব্দের অনুসরণে বা সাদৃশ্যে  কোন ধ্বনির পরিবর্তন বা নতুন শব্দ সৃষ্টি।যেমন-বাংলায় পাখপাখালি শব্দের সাদৃশ্যে সৃষ্টি হয়েছে গাছ গাছালি।

সাদৃশ্যের প্রভাবে ভাষার গঠনগত পরিবর্তনের দিকগুলো নিম্নরূপঃ 

সমতলীয়

সাদৃশ্যগত পরিবর্তনের একটি নিয়মিত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। এই শ্রেণীর পরিবর্তনকে সমতলীয় রূপে চিহ্নিত করা যায়। যেমন, বাংলায় বহুবচন নির্দেশে গুলো/গুলি (মনুষ্যবাচক ও অমনুষ্যবাচক বিশেষ্যের ক্ষেত্রে) ও-রা (মনুষ্যবাচক বিশেষ্যের ক্ষেত্রে) ব্যবহৃত হয়। এছাড়া স্ত্রী লিঙ্গের ক্ষেত্রেও সমতলীয় প্রক্রিয়া প্রযোজ্য।

 যেমন- বাঘ-বাঘিনী, নর্তক-নর্তকী, নট- নটী


পশ্চাৎ গঠন

 অনেক সময় সাদৃশ্যের প্রভাবে ভাষার অন্তর্ভুক্ত অন্য একটি উপাদান এর সাহায্যে নতুন উপাদান গঠিত হয়ে থাকে। এই শ্রেণীর সাদৃশ্যমূলক গঠনকে বলা হয় পশ্চাৎ গঠন। যেমন- অভিনয় শব্দ থেকে অভিনেতা লেখা শব্দ থেকে লেখক প্রভৃতি শব্দ সৃষ্টি হয়েছে। 


লোক নিরুক্তি

সাদৃশ্যের একটি বিশিষ্ট প্রকারভেদ হলো লোক নিরুক্তি। এই প্রক্রিয়া জটিল অপরিচিতি , দুর্বোধ্য শব্দ, ধ্বনি সাম্যর মাধ্যমে নতুন রূপ লাভ করে। যেমন-ইংরেজি Hospital থেকে বাংলায় হাসপাতাল, kalajar থেকে বাংলায় কালাজ্বর। সংস্কৃত প্রলয় থেকে বাংলায় পেল্লায় প্রভৃতি শব্দ সৃষ্টি হয়েছে।


সংক্রমণ

সংক্রমণ মূলক পরিবর্তনে লক্ষ্য করা যায় যে, যখন দুটো ভাব বা গঠন ভাষাভাষীর মনে প্রভাব বিস্তার করে, তখন তা পর্যায়ক্রমে অথবা দুটো  উপাদানকে একসঙ্গে এমনভাবে গ্রহণ করে যে  উভয় একত্রে সাঙ্গীভূত হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে দুটি ভাষাতাত্ত্বিক উপাদানে পরস্পরকে সংক্রমিত করে। যেমন- আমেরিকা ও কানাডায় ছুটির দিনে বিলম্বে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা না খেয়ে মধ্যাহ্ন ভোজের খানিকটা পূর্বেই খাবার গ্রহণের রীতি আছে। এই বিশেষ সময়ের ভোজনকে বলা হয় Brunch এ শব্দটি নিম্নোক্ত প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট-

Breakfast+lunch

Br+unch

Brunch


রূপমূলের অপব্যবহার

রূপমূলের অপব্যবহার ও এক ধরনের সংক্রমণের ফলে সাদৃশ্যজাত রূপমূল। এক্ষেত্রে দুটো রূপমূল প্রায় সমশ্রেণীর ধ্বনির দ্বারা গঠিত হলে রূপমূল দুটো একত্রে সাঙ্গীভূত হয়ে যায় এবং তার ফলে অর্থগত বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় । এই শ্রেণীর সাদৃশ্যগত পরিবর্তন অল্পশিক্ষিত ভাষাভাষীদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। যেমন, আমবাবুর বাগানে রাম পাড়তে গিয়েছিলাম (আমবাবু-রামবাবু, রাম=আম) । ধ্বনিগত দিক থেকে এই শ্রেণীর পরিবর্তনকে ধ্বনিবিপর্যয়রূপে চিহ্নিত করা যায়।


মিশ্রণ

সাদৃশ্যমূলক পরিবর্তনের ফলে দুটি ভিন্ন জাতীয় ভাষাতাত্ত্বিক উপাদান একত্রে মিশ্রিত হয়ে একটি নতুন উপাদান গঠন করে। এই প্রক্রিয়ায় বাংলা ভাষায় সৃষ্টি হয়েছে ‘ধোঁয়াশা’ ধোঁয়া এবং কুয়াশা এই দুটি শব্দের সংমিশ্রণে উক্ত শব্দটি সৃষ্টি হয়েছে।


পরিশেষে বলা যায় যে, ভাষা পরিবর্তনশীল। বিভিন্ন কারণে ভাষার এ গঠনগত পরিবর্তন বৈচিত্র্যময় । সাদৃশ্যের প্রভাবে ভাষার পরিবর্তন ধারা যেভাবে লক্ষ্য করা যায়,তা মূলত রূপমূলের গঠন ও অর্থগত পরিবর্তন।


কোন মন্তব্য নেই

enot-poloskun থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.