ঐতিহাসিক বা কালানুক্রমিক পদ্ধতি বলতে কি বুঝ?এ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য উদাহরণসহ বর্ণনা কর।

ঐতিহাসিক বা কালানুক্রমিক পদ্ধতি বলতে কি বুঝ?এ পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য উদাহরণসহ বর্ণনা কর।

ঐতিহাসিক বা কালানুক্রমিক পদ্ধতি বলতে কি বুঝ,পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য উদাহরণসহ বর্ণনা কর



ভাষা বিচারে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। বিষয় বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যগত দিক থেকে একটি পদ্ধতির সঙ্গে অন্য পদ্ধতির মূল পার্থক্য লক্ষণীয়। এই প্রক্রিয়ার জন্যই একটি পদ্ধতির কাঠামো অন্য পদ্ধতি থেকে স্বতন্ত্র।

ভাষাতত্ত্ব বিচারে যে পদ্ধতিগুলো প্রচলিত সেগুলি হচ্ছে ঐতিহাসিক, তুলনামূলক, বর্ণনামূলক বা গঠনমূলক ও রূপান্তরমূলক। উপরোক্ত পদ্ধতির মধ্যে সর্ব প্রাচীন হচ্ছে ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক পদ্ধতি। ভাষা পরিবর্তনশীল। দীর্ঘকালের ব্যবধানে ভাষার পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইতিহাসের ধারা তে যখন ভাষার বিচার-বিশ্লেষণ নির্ণয়ের চেষ্টা করা হয় তখন তাকে ভাষা বিচারের ঐতিহাসিক পদ্ধতি বলে অভিহিত করা হয়। কালের পরিক্রমায় ভাষার কালানুক্রমিক বিকাশ বিবর্তন ও পরিবর্তন ঘটেছে তাকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে ঐতিহাসিক ভাষা বিচার পদ্ধতি।নিচে ঐতিহাসিক পদ্ধতি ও এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ


ঐতিহাসিক পদ্ধতিঃ

ভাষা সম্পর্কে আলোচনা ও ভাষার বিশ্লেষণ দু'ভাবে হতে পারে-

ক)কোনো ভাষার বিভিন্ন কালের বিবর্তনের ধারা বিশ্লেষণ।

খ)কোনো ভাষার একটি নির্দিষ্ট কালের রূপ বিশ্লেষণ ও বর্ণনা।

কোন ভাষার বিভিন্ন কালের বিবর্তনের ধারা বিশ্লেষণ করা হয় ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বে। কালক্রমিক ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান এর ইংরেজি হলো diachronic/historical. Dia শব্দের অর্থ অতিক্রম করে বা পেরিয়ে, chronos শব্দের অর্থ হলো কাল বা সময়; অতএব diachronic শব্দের অর্থ যা একটি  কালকে অতিক্রম করে যায় বা বিভিন্ন কালের ধারা অনুসরণ করে।সুতরাং বলা যায়,ভাষাতত্ত্বের যে শাখায় ভাষাপরিবর্তনের ধারাটি কাল বা সময়ের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা হয়,তাকে বলা হয় ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব।


পটভূমিঃ

পৃথিবীর যেকোন ভাষার ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। এর পটভূমিতে গড়ে উঠে সে ভাষার ইতিহাস। প্রাচীন অতীতে ভাষার অবস্থান বা স্বরূপ কিরূপ ছিল আর পরবর্তীতে তার অবস্থান কী দাঁড়াল, শেষ পর্যন্ত বর্তমানে আধুনিক অবস্থায় কিভাবে এলো তার বর্ণনা ঐতিহাসিক পদ্ধতিতে পাওয়া যায়।

উনিশ শতকেই ভাষাবিজ্ঞানীদের হাতে ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের পদ্ধতিগত ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়। ভাষা বিচারের এ পদ্ধতিগত এ ক্ষেত্রকে কাজে লাগিয়েছেন বপ,গ্রিম,ভার্ণার গ্রাসম্যান,ফেদিন,সোস্যূর।তাঁরা বিভিন্ন ভাষার ঐতিহাসিক বিকাশের প্রক্রিয়া উদঘাটন করেছিলেন এবং তৈরি করেছিলেন ভাষা পরিবর্তন সম্পর্কে সর্বজনীন তত্ত্ব।ভাষাতত্ত্বের এ শাখাটি পরিচিতি লাভ করে ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব নামে।

ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের অপর নাম কালানুক্রমিক ভাষাতত্ত্ব (Diachronic linguistic)।

ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বে সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন সময়ে ভাষা বিবর্তনের কালানুক্রমিক ইতিহাস,বিবর্তনের ফলে ভাষার পূর্বরূপের গঠনগত পরিবর্তন, ভাষার আদি রূপের গঠন ইত্যাদি দিক পর্যালোচনা করা হয়।ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বে কোনো ভাষার প্রাচীনতম রূপ থেকে আধুনিক রূপ পর্যন্ত ধারাবাহিক বিবর্তনের ইতিহাস এবং তথ্য সংবলিত প্রমাণের মাধ্যমে ভষার গঠনগত বৈশিষ্ট্য (ধ্বনিগত,রূপগত,বাক্যগঠনগত) জানা যায়। অর্থাৎ আধুনিক কালে ব্যবহৃত বাংলা ভাষার আদিরূপ কী ছিল,কেমনভাবে তা বিভিন্ন স্তরে স্তরে ধ্বনিগত,রূপগত, বাক্যগত ও এমনকি অর্থগত রূপান্তরিত হতে হতে আধুনিক রূপ পরিগ্রহ করেছে।


উদাহরণঃ

আমি শব্দটি ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের সাহায্যে বিশ্লেষণ করা যায় এভাবে- আমি শব্দটির আদি উৎস হলো সংস্কৃত অস্মাভিঃ, অস্মাভিঃ পরিবর্তিত হয়ে প্রাকৃত ভাষায় হলো অমহাহি; তা থেকে অপভ্রংশে হলো অমহহি,অপভ্রংশের পরে প্রাচীন বাংলায় হলো আক্ষ্মে; আক্ষ্মি; শেষে আধুনিক বাংলায় হলো আমি। ভাষার এরূপ ধারাবাহিক পরিবর্তন আলোচনা করা হয় ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বে।

এই স্তরভিত্তিক আলোচনা ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের মাধ্যামে দেখানো হয়। যেমন- বাংলায় চাঁদ শব্দটি এসেছে প্রাকৃত চন্দ থেকে,আবার চন্দ এসেছে সংস্কৃত চন্দ্র থেকে অর্থাৎ বাংলা চাঁদ< প্রাকৃত চন্দ <সংস্কৃত চন্দ্র।

অনেক সময় ধ্বনি পরিবর্তনের ফলে ভাষার প্রাচীন রূপ হারিয়ে যায় বা লুপ্ত হয়ে যায়, তখন ধ্বনি পরিবর্তনের ধারাকে বিশ্লেষণ করে ও হারিয়ে যাওয়ার সময় কোনো পূর্বরূপের চিহ্ন দেখে লুপ্ত হওয়া উপাদান কী ছিল তা অনুমান করা হয়।


ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের বৈশিষ্ট্য


  • ক)ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বকে গতিশীল বলে ধরা হয়।
  • খ)ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব ভাষা পরিবর্তনের সার্বিক ধারায় বিশ্বাসী।
  • গ)ভাষার বংশানুক্রমিক রূপ বর্ণনাতে ইতিহাসের সাক্ষ্য অপরিহার্য।
  • ঘ)ভাষার বিভিন্ন স্তর বিন্যাসে ইতিহাসের প্রেক্ষাপট একান্তভাবে প্রয়োজনীয়। ভাষার ধ্বনি,শব্দ,বাক্য প্রভৃতির উৎসমূল কালিক বিবর্তনের মাঝে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
  • ঙ)ভাষা পরিবর্তনের বিভিন্ন সূত্র ইতিহাসের ধারাতে তৈরি সম্ভব।
  • চ)ভাষার পুনর্গঠন মূল ভাষা বংশের বিভিন্ন পরিবারের বিভিন্ন সময়ে রূপের সাহায্যে করা সম্ভব।
  • ছ)ভাষাসমূহের একটি আদিমূলের ধারণা ও ইতিহাসের বা কালের ধারাতেই করা সম্ভব হয়েছে।


ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের পরিধিঃ

ক)পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার গোত্র বা বংশ নির্ণয়।

খ)ভাষার কালিক পরিবর্তন, বিবর্তন ও রূপান্তরের ঐতিহাসিক বর্ণনা।

গ)রূপতাত্ত্বিক বিভিন্ন অবস্থা যেমন- শব্দ,পদ, বিভক্তি,প্রত্যয় প্রভৃতির বর্ণনা ও বিচার-বিশ্লেষণ।

ঘ)ভাষার আদি রূপের পুনর্গঠন, ব্যুৎপত্তি, উৎস সন্ধান ও তার বিবরণ তৈরি।


ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের উপকরণঃ


  • ক) লিখিত দলিল,পান্ডুলিপি,লিপি ও শিলালিপি প্রত্নলেখ প্রভৃতি।
  • খ) অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক পরিবর্তন ও বিবর্তনের কালানুক্রমিক ইতিহাস।
  • গ) রাজনৈতিক, সামাজিক,পারিবারিক অবস্থার কালানুক্রমিক ইতিহাস।
  • ঘ) ভাষার শব্দ ভান্ডারের কালানুক্রমিক সংগ্রহ।
  • ঙ)ভাষার কাঠামোগত অর্থগত পরিবর্তনের ইতিহাস।


কালগত পর্বঃ


ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বের ক্ষেত্রকে সহজভাবে ব্যাখ্যার জন্য কালের দিক থেকে ইতিহাসের দুটি পর্বে ভাগ করা হয়েছে।


  • ১)প্রাগৈতিহাসিক পর্ব,
  • ২)ঐতিহাসিক পর্ব।

যে সময়কাল পর্যন্ত ইতিহাসের লিখিত উপাদান, উপকরণ ও দলিল প্রমাণ পাওয়া যায় সে সময় পর্যন্ত ঐতিহাসিক যুগ নির্ণয় করা হয়। পৃথিবীর অনেক প্রাচীন ভাষার ক্ষেত্রে এ অবস্থা পরিলক্ষিত হয়।যেমন আর্য ভাষাভাষী মানুষ যে সময়ে ভারতবর্ষে এসেছিল সেসময়ের তাদের ভাষার কোন লিখিত রূপ পাওয়া যায়নি তাই এই সময়ের তাদের ভাষার রূপ ছিল প্রাগৈতিহাসিক।


উপসংহার

ভাষা মাত্রই সময়ের সাথে সাথে বিবর্তিত হয়।ভাষার পূর্ববর্তী রূপ কিংবা বিবর্তনের পূর্ববর্তী স্তরের সাথে পরবর্তী স্তরের যে পার্থক্য ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বে তা উদঘাটন করা হয়। এই পদ্ধতিকে অনেকেই প্রগতিশীল বা গতিসম্পন্ন পদ্ধতি বলে মনে করেন।  


কোন মন্তব্য নেই

enot-poloskun থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.