ক্লাসিসিজম ও নিওক্লাসিসিজম কাকে বলে? ক্লাসিসিজম ও নিওক্লাসিসিজম এর মধ্যে মিল ও অমিলগুলো আলোচনা কর ।

   ক্লাসিসিজম ও নিওক্লাসিসিজম কাকে বলে? ক্লাসিসিজম ও নিওক্লাসিসিজম এর মধ্যে মিল ও অমিলগুলো আলোচনা কর ।  

বাংলা সাহিত্য



প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্যকে আমরা সাধারণভাবে অভিহিত করে থাকি ‘ক্লাসিক্যাল বা ধ্রুপদী সাহিত্য বলে।ক্লাসিসিজম আভিধানিক অর্থে প্রাচীনকালের শ্রেষ্ঠ রচনাদি আদর্শরূপে গ্রহণ করার ঝোঁক বা ঐগুলোর অনুকরণ। যে সাহিত্য কালজয়ী ,যে সাহিত্য সংযত ভাষায়,সুসংহত চিন্তার সম্ভ্রম ও ঔজ্জ্বল্যে রচিত,তার রীতি ও আদর্শকে অনুসরণ করার প্রবণতা হলো ক্লাসিসিজম।

  

অন্যদিকে নিওক্লাসিসিজম বা নব্য ক্লাসিকবাদ একটি সাহিত্যতত্ত্ব।এটি ক্লাসিক সাহিত্যের একটি পরিপূর্ণ রূপ।এর সময়কাল কারো কারো মতে ১৬৬০-১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ।কারো কারো মতে ১৬৬০-১৭৭৯। আবার কেউ কেউ বলেছেন ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ Wordsworth ও Colridge এর Lirical Ballads রচিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত।


ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, ইউরোপে রোমানরা উচ্চ অর্থে প্রথম ক্লাসিক শব্দটি ব্যবহার করেন।যারা  সামাজিক ও আর্থিক দিক থেকে ‘সর্বোচ্চ’ বলে বিবেচিত,তাদেরকে বলা হতো ‘ক্লাসিকাই’।রোমানরা উন্নত লেখক বোঝাতে ‘ক্লাসিকাস’ কথাটি প্রথমে ব্যবহার করে।

পরবর্তী সময়ে সাহিত্যে ক্লাসিক বলতে বোঝায় এমন এক সাহিত্যধারা-যা প্রাচীন ও শুদ্ধতাশ্রয়ী; বিষয় ও আঙ্গিকে আছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য ।ক্লাসিক সাহিত্যকে বাংলায় ধ্রুপদী সাহিত্য বলা হয়।কেউ কেউ কালজয়ী সাহিত্য নামেও অভিহিত করেছেন।


অপরদিকে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে একদল লেখক ক্লাসিক সাহিত্যের উঁচু ভাব ও মান তথা সংযম,শৃঙ্খলা,আভিজাত্য,যৌক্তিকতা ইত্যাদিকে সাহিত্যের ধর্ম বলে মান্য করেন এবং সর্বোপরি প্রকরণেও প্রাচীনযুগের স্থাপত্যরীতিতে গ্রহণ করে সাহিত্যে যে নতুন ধারা সৃষ্টি করেন,তাই নিও ক্লাসিসিজম।এ শ্রেণির লেখকেরা তাদের সৃষ্টিসম্ভারের মধ্য দিয়ে একটি যুগের সৃষ্টি করেন।ইতিহাসে এই যুগ নিও ক্লাসিক যুগ বা নব্য ধ্রুপদী যুগ বলে চিহ্নিত হয়ে আছে।



            


  ক্লাসিসিজম ও নিও ক্লাসিসিজম এর মধ্যে মিল ও অমিল



ক্লাসিসিজম ও নিওক্লাসিসিজম এর মধ্যে অনেক মিল ও অমিল রয়েছে । নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ


  • ১)ক্লাসিক বা ধ্রুপদী সাহিত্য গুলি উচ্চ অঙ্গের এবং ধারণ করে প্রাচীন রীতি ও বৈশিষ্ট্য,ক্লাসিক সাহিত্য গুরুত্ব দেয় ঐতিহ্য,সংযম,নিয়ম-শৃঙ্খলা ও পরিমিতিবোধকে।বিষয় নির্বাচনে সচেতন।গাম্ভীর্য,সরলতা,স্পষ্টতা,পরিচ্ছন্নতা তাদের বৈশিষ্ট্য।ক্লাসিসিজমের দৃষ্টি হলো প্রখর-সূর্যালোকে দেখা,স্পষ্ট করে দেখা,খুটিয়ে খুটিয়ে দেখা।ফলে এ রচনা স্বচ্ছ,পরিষ্কার।ভাবে শান্ত,চলনে ধীরস্থির; বস্তুনিষ্ঠতা তার প্রধান লক্ষণ

  • অন্যদিকে, নিওক্লাসিক লেখকগণের ঐতিহ্যপ্রীতি প্রবল।তারা সন্দেহ পোষণ করেন নতুন কোন বিপ্লব বা সৃষ্টি সম্পর্কে।তারা রোমান সাহিত্যকে উচুমানের রচনা বলে মান্য করে এবং সে রীতি ও ঐতিহ্যকে অনুসরণ করেন শ্রদ্ধার সাথে।এই সাহিত্যকেরা আসলে ক্লাসিক সাহিত্যকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।নিওক্লাসিকাল সাহিত্যের ভাব হবে মহৎ। উন্নত ভাষা পরিশীলনের মাধ্যমে তা মানুষের চিত্তে উতকর্ষতা সৃষ্টি করবে।সাহিত্যের ভাষা হবে সব সময়ই উন্নত পরিশোধিত এবং পরিচর্যাপূর্ণ।যেসব ভাষা বা শব্দ সঠিক ভাব প্রকাশ করতে অক্ষম তা বর্জন করতে হবে।নিওক্লাসিক সাহিত্যিকেরা হোরেসের এই সাহিত্যতত্ত্ব বেশ ভালোভাবেই আত্তস্ত করেছিলেন।

  • ২)ক্লাসিসিজম বা ধ্রুপদী শিল্পভাবনা ও আঙ্গিকের মূলে রয়েছে এক প্রথানুগ,রক্ষণশীল,আভিজাত্যপূর্ণ জীবনদৃষ্টি।জীবনের বহুবিচিত্র গতিশীল নিত্যপ্রবাহমানতার প্রতি তাদের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়নি।সামাজিক আচার-বিচার,নিয়মানুবর্তিতা,মানবজীবনের বহিরঙ্গ বিষয়ে কৌতূহল এবং যুক্তিশৃঙ্খলায়,প্রাকরণিক উৎকর্ষে নিঁখুত শিল্পকর্মনির্মাণই ছিল তাদের স্থির লক্ষ্য।

  • বিপরীত দিকে নিওক্লাসিকবাদী সাহিত্য যেসব ধ্রুপদী বা মানব সংবেদনশীল সাহিত্য কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে সেগুলোকে গুরুত্ব প্রদান করেছে এবং অনুসরণ করেছে।নব্য ক্লাসিকবাদী সাহিত্য রচনারীতি বা আঙ্গিকের উপর গুরুত্বদান করা হয়েছে।এখানে উপমা,ছন্দ,ভাষা,অলঙ্কার প্রভৃতির শৈল্পিক প্রয়োগ লক্ষণীয়।

  • ৩)ক্লাসিক রচনার মহত্ত্ব ও নৈতিকতা আমাদের জীবনবোধকে শাণিত করে।ক্লাসিক রচনায় থাকবে জ্ঞানের সঙ্গে শালীনতা।নিজের সম্পদ ও বৈশিষ্ট্যকে নিয়ে তৈরি করবে উপাদান হয়ে।ক্লাসিক সাহিত্য আত্মাকে সমৃদ্ধ করে।

  • অপরদিকে,নিও ক্লাসিকাল সাহিত্যিকগণের কাছে সাহিত্যের বিষয় বা বিষয়ের মৌল উৎস মানুষ-সভ্য সমাজের সভ্য মানুষ।তারা মনে করেন,সভ্য মানুষই সাহিত্যে প্রতিনিধিত্ব করবে।সভ্য মানুষের দীপ্ত ও দৃঢ় পদক্ষেপ অনুসরণে অগণিত মানুষ এগিয়ে যাবে সামনে-রাঙিয়ে তুলবে তাদের চিন্তাশক্তি ও কল্পনাকে।তারা স্থির করেন,মানুষের মহৎ ভাবনা ও অঙ্গীকারকে অপরিসীম পবিত্রতায় ও মাধুর্যে,সৌকর্যে ও অনন্যতায় তুলে ধরবেন সাহিত্যে এবং এই সাহিত্য মানবতাকে সুসংহত ,দৃঢ় ও সজীব করবে।

  • ৪) ক্লাসিক সাহিত্যে সত্যের উপস্থিতি অনিবার্য- যে সত্য ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উজ্জ্বল আলোয় জাতিকে ঠিক পথটি দেখিয়ে দেয়।আর এই সত্যের সঙ্গে থাকবে রুচি।পৃথিবীতে রুচি একেক জনের একেক রকম।রুচির ভিন্নতা থাকা স্বাভাবিক ও সঙ্গত।কিন্তু সাহিত্যে রুচি হচ্ছে এমন একটা মানদন্ড যা সভ্য সমাজে গ্রহণীয়,শোভনীয় এবং যা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের সমাজ,আমাদের অনুভূতি,আমাদের চিন্তার ক্ষেত্রকে।


  • নিওক্লাসিকাল সাহিত্যিকেরা রুচিবোধকে তারা সাহিত্যের নান্দনিক বৈশিষ্ট্য বলে মনে করেন।সেই সূত্রে নৈতিকতা যেমন তাদের আরাধ্য তেমনি বর্জনের বিষয় হলো ইন্দ্রিয় তথা দেহজ কামনা বাসনা।




                   পরিশেষে বলা যায় যে,নিওক্লাসিসিজম সাহিত্যের জন্ম হয়েছিল ক্লাসিসিজমেরই পথ ধরে।ক্লাসিসিজমের জন্ম মূলত গ্রীক বা রোমানে-কিন্তু নিওক্লাসিসিজমের উদ্ভব ও চর্চা হয় প্রধানত ইংল্যান্ডে।পরবর্তীতে বিভিন্ন দেশে এর বিস্তার ঘটে।


কোন মন্তব্য নেই

enot-poloskun থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.