রবীন্দ্রনাথ কোন অর্থে রোমান্টিক কবি আলোচনা কর
রবীন্দ্রনাথ কোন অর্থে রোমান্টিক কবিআলোচনা কর
শিল্প সাহিত্যে একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং রূপের নাম রোমান্টিকতা।কল্পনাশক্তির উপর অগাধ বিশ্বাস রোমান্টিকতার প্রথম শর্ত।প্রত্যক্ষ-সীমার বাইরের যে দেখা তাই রোমান্টিক দর্শনের ভিত্তি।রোমান্টিক কবিরা তাঁদের কাব্যের বিষয় করে তোলে অতীন্দ্রিয়ের জগতকে।রোমান্টিক কবিরা চোখের বাইরের কিছুকে অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে সন্ধান করেন।আপন অন্তরের আলোয় রোমান্টিক কবিরা অদেখাকে দেখেন এবং অধরাকে ধরেন।মূলত কল্পনা প্রবণতার অসাধারণ বিকাশ-উদ্বেলতা রোমান্টিক কবিতার মূল লক্ষণ।রোমান্টিক কবি বা শিল্পীর মূল স্বভাব অকারণ বেদনাবোধ।
অসামান্য প্রতিভার অধিকারী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর[১৮৬১-১৯৪১] আধুনিক বাংলা কবিতার প্রাণপুরুষ।কবিতা ছাড়াও ছোটগল্প,উপন্যাস,নাটক,প্রবন্ধ বিভিন্ন রচনায় তিনি অনন্য হয়ে আছেন।তার সাহিত্যসাধনার একটি বৃহৎ কাল বাংলা সাহিত্যের ‘রবীন্দ্রযুগ’ নামে পরিচিত।মানবধর্মের জয় ও সৌন্দর্য ,রোমান্টিকতা তার সাহিত্য সাধনার মূল সুর।
রোমান্টিক কবির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে,তিনি জীবনের দৈনন্দিন বাস্তবতাকে এবং বাস্তবভিত্তিক চেতনাকে ছাড়িয়ে যান; কল্পনার মায়াময় পরিবেশে সৌন্দর্যকে অনুসন্ধান করেন এবং তাকে স্বপ্নময়,মোহময়,আদর্শময় করে তোলেন।এই অর্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলা যায় রোমান্টিক কবি। কারণ তাঁর কাব্যের জগতটি ছিল প্রধানত ও প্রায় পুরোপুরি কল্পনা রঙ্গিন।মূলত বাংলা কবিতায় রোমান্টিক অনুভবের পরিসরে আমরা রবীন্দ্রনাথ এবং জীবনান্দকে স্বচ্ছন্দে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখি।তবে বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিকতার ছোঁয়া লাগে বিহারীলালের হাত ধরে।কিন্তু বাংলা কাব্যে পরিপূর্ণ রোমান্টিকতা আনয়ন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মানসী’ ‘সোনার তরী’ ‘চিত্রা’ কাব্যের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের রোমান্টিকতার যাত্রা শুরু হয়।বিশ্বকবির রোমান্টিকতার নিদর্শন হচ্ছেঃ
“আমার চেতনার রঙ্গে পান্না হলো সবুজ
চুনি উঠলো রাঙা হয়ে,
আকাশের দিকে তাকিয়ে বললাম সবুজ
সবুজ হলো সে।”
সামগ্রিকভাবে সমগ্র রবীন্দ্র কাব্যে রয়েছে এক অখন্ড জীবনবোধের গুরুত্ব অনির্বচনীয় আনন্দ ও সৌন্দর্যবোধ এবং মানব ও বিশ্বের প্রতি সুগভীর অনুরাগ।কবির এই বোধ ও বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছে কবির কাব্যসাধনার দুটি পর্বে।
প্রথম পর্বে বনফুল থেকে শুরু করে গীতাঞ্জলি পর্যন্ত কাব্যগ্রন্থে কবির যে জীবন জিজ্ঞাসা ও অনুভব তা মূলত রোমান্টিক কবির আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাসের মাধুরীয়ময়।প্রকৃতি,মানবজীবন ও অরূপচেতনা সবই কবির চোখে ধরা পড়েছে আত্মগত অনুভবের আলোকে।এখানে কবির আত্মগত মুক্তির একটি অভিপ্রায় ও লক্ষণীয়।তাকে বলা হয়েছে ‘সীমার মধ্যে অসীমের মিলন সাধনের পালা।এই পালায় র এক অপরিসীম আকুলতা নিয়ে কবি চেয়েছিলেন ‘জগত দেখিতে হইব বাহির।’ দেখা গেল,রোমান্টিক কবি পৃথিবীর ধূলিকে দেখলেন না।তিনি ভাবলেন, তাঁর স্থান বাস্তবাতীত সৌন্দর্যলোকে।তিনি ভাসলেন তাই অসীমের নৌকায়।দৃষ্টি ফেরালেন সুদূর অতীতে মহাকবি কালিদাসের কালেঃ
“দূরে বহুদূরে
স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনীপুরে
খুঁজিতে গেছিনু কবে
শিপ্রা নদী পারে
মোর পূর্ব জনমের
প্রথমা প্রিয়ারে।”
উর্বশী-বিজয়িনীর স্বপ্নলোক তাঁকে অভিভূত ও আচ্ছন্ন করেছে।কিন্তু শেষ পর্যন্ত কবি যখন বুঝেছেন,উর্বশী-বিজয়িনীর কল্পনা সুন্দর হলেও তা কেবল স্বপ্ন,অলীক ও অবাস্তব,তখনই তার মনে পড়েছে মাটির পৃথিবীর কথা,ভূতলের স্বর্গখন্ডগুলির কথা।কবি ব্যাকুল হয়ে বলে উঠেছেন, ‘এবারে ফিরাও মোরে।’ তিনি বুঝেছেন,সীমাকে এড়িয়ে অসীমকে পাওয়া যায়না।গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের এই বোধ পর্যন্ত কবির উপলব্ধি পুরোপুরি রোমান্টিক।এমনকি গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থে কবি যে মরমিয়া জগতকে উপহার দিয়েছেন তাও রোমান্টিক কবির নিভৃত অধ্যাত্ম অনুভূতি।
এরপর থেকে রবীন্দ্রকাব্যে পালাবদল দেখা গেছে।বলাকা থেকে শেষলেখা পর্যন্ত কাব্যপরিক্রমায় কবি বিশ্বপথিক।আত্মগত জীবনবোধের জায়গায় বিশ্বমানবতাবোধ এ পর্বের কবিতায় প্রধান হয়ে উঠেছে। তাঁর কবিতায় এসেছে যুদ্ধ,সংঘাত ও কর্মের দাহনে ক্ষুব্ধ কোলাহলময় পৃথিবীর রূপ মরণ সমুদ্রের পারে দাঁড়ানো বিপর্যস্ত মানবতার ছবি।উচ্ছল নিসর্গ উপাসনার জায়গায় এসেছে নিরাসক্ত প্রকৃতি চেতনা।কল্পলোকের মানবের জায়গায় এসেছে মানুষের নিরবচ্ছিন্ন কর্মপ্রবাহ। সর্বোপরি এসেছে বিপন্ন মানবতার জন্য গভীর মমত্ববোধ।কবি শেষ পর্যন্ত এই স্থির বিশ্বাস ও সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও ঘুরে ফিরে স্মৃতিকে আশ্রয় করে,আত্মগত বেদনাবোধের পাখায় ভর করে প্রায়শই রোমান্টিক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর কবিতার অবয়বে।কোন অপরাহ্ন বেলায় একান্তই মানবী গৃহবধূকে সম্ভাষণ করতে গিয়ে রোমান্টিক আবেশেই তাকে দেখেছেন কালিদাসের কালের নায়িকা রূপে।রোমান্টিক কবি বলেছেনঃ
“তবু শূন্য শূন্য নয়
ব্যথাময়
অগ্নিবাষ্পে পূর্ণ সে গগন
একা একা সে অগ্নিতে
দীপ্তগীতে
গড়ে তুলি স্বপ্নের ভুবন।”
দ্বিতীয়ত,রোমান্টিক কবির কাব্যবাণীতে আবেগের উচ্ছ্বাস প্রধান হয়ে ওঠে ।রবীন্দ্রনাথের কবিতায় এ বৈশিষ্ট্য প্রায়ই লক্ষ করা যায়।প্রত্যাশা কবিতায় কবি বলেছেনঃ
“প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ ফাগুন মাসে
কী উচ্ছ্বাসে
ক্লান্তিবিহীন ফুল ফোটানোর খেলা।
ক্ষান্ত কুজন শান্ত বিজন সন্দধ্যাবেলা
প্রত্যহ সেই ফুল্ল শিরীষ প্রশ্ন শুধায় আমায় দেখি
এসেছ কি।”
প্রধানত প্রেম ও প্রকৃতি দুটি ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথ পুরোপুরি রোমান্টিক । তাঁর কাব্যে আবেগশীল,দেহসচেতন,অলজ্জ প্রেম অনুপস্থিত নয়,কিন্তু তাঁর প্রেম মূলত ভাববিলাসীর প্রেম। তার কাব্যের প্রিয় বা প্রিয়তমা মানুষ হলেও তাতে শরীরী প্রেম প্রধান নয়,প্রধান হয়ে উঠেছে প্রেমের আদর্শ ,ভাবলোকের প্রেম।
প্রকৃতিকেও রবীন্দ্রনাথ রোমান্টিক দৃষ্টিতে দেখেছেন।তিনি ছিলেন প্রকৃতির সচেতন উপাসক।নিসর্গ-সৌন্দর্য তাঁর কাছে ছিল বিশ্বের মৌল সত্যের নিত্য ও অভ্রান্ত প্রকাশ।নিসর্গ প্রকৃতি তাঁর চোখে কোনদিন অন্তহীন ব্যাপ্তির সৌন্দর্য হারায়নি।তাই প্রকৃতিকে তিনি দেখেছেন ব্যাক্তির অনুভূতি নিয়েঃ
“যখন রব না আমি মর্তকায়ায়
তখন স্মরিতে যদি হয় মন
তবে তুমি এসো হেথা নিভৃত ছায়ায়
যেথা এই চৈত্রের শালবন।”
সুতরাং রবীন্দ্রনাথের কাব্যে প্রধানত ধ্বনিত রোমান্টিক সৌন্দর্যকুঞ্জের পাখির গান।আঘাত-জর্জরিত জীবনের কঠিন বাস্তব থেকে দূরে রোমান্টিক সৌন্দর্যলোকে তার অধিষ্ঠান।যদিও একসময় তা বাস্তবের কঠিন মাটিতে এসে দাড়িয়েছে।কিন্তু তার কাব্যে কবিতায় রোমান্টিক অনুধ্যান,সৌন্দর্যের প্রতি আকাঙ্খা,অকারনে বিরহবোধ-বেদনাবোধ ,ভাবানুভূতির প্রকাশ এ সব কারনেই বিশবকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে একজন সার্থক রোমান্টিক কবি
কোন মন্তব্য নেই