লুঙ্গিনাসের মতে উৎকৃষ্ট সাহিত্য কী?এর বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি আলোচনা কর ।

লুঙ্গিনাসের মতে উৎকৃষ্ট সাহিত্য কী?এর বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি আলোচনা কর 


বাংলা সাহিত্যে লুঙ্গিনাসের সাহিত্যতত্ত্ব
বাংলা সাহিত্য



প্রাচীন সাহিত্য বিচার পদ্ধতিতে যিনি যুগান্তর এনেছিলেন,তিনি হচ্ছেন লুঙ্গিনাস (খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতক) । রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বৃহৎ জীবনবোধের আদর্শে তিনি সাহিত্যকে ঊর্ধবতর সত্তায় তুলে ধরেছিলেন। 'On the Sublime' বা 'Peri Hypsos' নামক প্রসিদ্ধ গ্রিক সমালোচনা গ্রন্থটি তাঁর রচনা।এ গ্রন্থে প্রধানত রোমান্টিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে কাব্যের লক্ষ্য ও পরিণতি নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন।সে সাথে সাহিত্যের নানাবিধ বাস্তব সমস্যা ও আলোচিত হয়েছে।

সাহিত্য জীবনের অনুকরণ হলেও শুধু জীবন উপস্থাপনাই সাহিত্যের একমাত্র উদ্দেশ্য নয়।কাব্য বা সাহিত্যকে যথাযথরূপে সার্থক হয়ে উঠতে প্রয়োজন গভীর ধ্যান এবং অলংকার সহযোগে ভাষাকে নব রূপ প্রদান করা।এর মাধ্যমেই সাহিত্য হয়ে উঠবে মহিমান্বিত সুন্দরতর এক শিল্প বিশেষ। শিল্পকে এই সুন্দরতর ও মহিমান্বিত হওয়াকে লুঙ্গিয়াস একে Sublime বলে অভিহিত করেছেন।

সাবলাইম শব্দটির আভিধানিক অর্থ মহিমান্বিত,মহামহিমান্বিত,ভীষণ সুন্দর।কেউ কেউ বলেন,সাবলাইমের বাংলা হচ্ছে উৎকর্ষ,কেউ বলেন মহৎ।
লুঙ্গিনাসের ভাষায় সাবলাইম হচ্ছে- 
'রচনার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য-যা আমাদে আত্মাকে উন্নত করে,আমরা গর্বের মহিমায় এবং স্পর্ধিত আনন্দের অনুভূতিতে পরিপূর্ণ হই,ঠিক যেন মনে হয়,এ আমাদের রচনা।

শিল্প সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের একমাত্র মাধ্যম হলো Sublimity. লঙ্গিনাস হোমার থেকে ডিমস্থিনিস পর্যন্ত গ্রিক সাহিত্য বিশ্লেষণ করে 'Sublime' তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সে সাথে তিনি সমাজ ও সাহিত্যের মধ্যে যোগাযোগ কোথায় সে বিষয়েও আলোকপাত করেছেন। On the submile গ্রন্থে সাহিত্যের স্টাইল বা রচনারীতি,সাহিত্য বিচারের মাপকাঠি ও মূলতত্ত্ব,সাহিত্যে নীরসতা,মেকিত্ব,সমালোচনা,সাহিত্যে অলংকার ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়ে সংহত ,যুক্তিপূর্ণ ও সাহিত্য গুণান্বিত আলোচনা স্থান পেয়েছে।নিম্নে সাহিত্য সম্বন্ধে লুঙ্গিনাসের উৎকৃষ্ট পাঁচটি উৎসের কথা তুলে ধরা হলোঃ

১)মহৎ ভাবনাঃ
উন্নত বা মহৎ ভাবসৃষ্টি করতে হলে লেখককে প্রথমে একটি মহৎ বিষয়বস্তু বা ধারণার উপস্থাপন করতে হবে।লুঙ্গিনাসের কাছে,মহৎ ভাব হচ্ছে,মহৎ মনের মহৎ ভাবনা।আর তার এই মহত্ব আত্মিক।আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যা 'বড় রকমের ঘৃণার বস্তু' তা যেমন কখনোই মহৎ নয়,তেমনি সাহিত্যের জগতেও তা মহৎ বিষয় বলে গণ্য হবেনা।লুঙ্গিনাস লেখককে তার রচনায় 'আত্মার মহত্ব' প্রকাশের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেন।তাঁর মতে,আত্মার মহত্ব সহজাত,অর্জনযোগ্য কোন গুণ নয়।তাই তিনি আত্মার মহত্বকে পরিপূর্ণতা দিতে,উন্নত মানসিকতা সৃষ্টি করতে,মানুষের মনকে শিক্ষা ও মহৎ প্রেরণা দিয়ে নিরন্তর সঞ্জীবিত করে তুলতে লেখককে বিশেষভাবে নির্দেশ প্রদান করেন।লুঙ্গিনাসের কাছে বক্তব্যের উৎকর্ষ ও সৌন্দর্য 'এক মহৎ প্রাণের প্রতিধ্বনি।' 

উৎকর্ষ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কোন কোন লেখক বাগাড়ম্বরতা সৃষ্টি করেন। বাগাড়ম্বরতা বা বাচালতা ভাষার ঐশ্বর্য ও আড়ম্বরকে নষ্ট করে বলে লুঙ্গিনাস এগুলোকে চমৎকারিত্বের সম্পূর্ণ বিপরীত বলে মনে করেন।

২)মহৎ আবেগঃ
একজন লেখকের মনে অনেক আবেগের সমাবেশ ঘটে।আবার লেখকের সৃষ্ট চরিত্রেও নানা ভাব,আবেগের সমাবেশ ঘটে।লুঙ্গিনাস মনে করেন,লেখককে 'আবেগঘন চূড়ান্ত মুহূর্তগূলোর নির্বাচন এবং একটি একক সত্তায় তাকে মূর্ত করে তোলার ক্ষমতাই লেখাটিকে বিশিষ্টতা দান করে। লক্ষ্য রাখতে বলেছেন, নির্বাচিত আবেগ যেন বাস্তব জীবনের অনুভূতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় এবং লেখক যেন গভীর আবেগের চূড়ান্ত ও তীব্র রূপকে নৈপুণ্যের সঙ্গে লেখায় চিত্রিত করেন।

৩)অলঙ্কারঃ
লুঙ্গিনাস মনে করেন, লেখকের কলাকৌশলজাত প্রচেষ্টার মধ্যে অলঙ্কার সৃষ্টি অন্যতম এবং অলঙ্কার যথাযথভাবে ব্যবহৃত হলে রচনার চমৎকারিত্ব প্রকাশে ভালো অবদান রাখে।আবার অলংকার যদি লাগামহীনবভাবে প্রয়োগ করে রচনার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নসাপেক্ষ করে তোলে ,তবে তাকে কপটতা বা ছলনাই বলতে চান লুঙ্গিনাস।তিনি মনে করেন,আলঙ্কারিক বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে বেশি কার্যকর তখনই,যখন বোঝা যায়না যে,তা অলঙ্কার।

৪)কবিভাষাঃ
ভাষা প্রকাশভঙ্গির পরিচয় বহন করে।রচনাকে মহিমান্বিত করতে হলে কবিকে সৃষ্টি করতে হবে নিজের পরিচয় জ্ঞাপক ভাষা,যার নাম কবিভাষা।
কবিভাষা হচ্ছে কবির রচনাশৈলীর পরিচয়জ্ঞাপক একটি বৈশিষ্ট্য।কোন রচনার একটি পঙক্তি পড়লেই,রচনাটি কার,তা বোঝা যায়।যেমন আমাদের ভাষার রবীন্দ্রনাথ,নজরুল,লালন প্রমুখ কবিদের একটু পড়লেই পাঠক বোঝতে পারে,রচনাটি কার।

৫)রচনাশৈলীঃ
পাশ্চাত্যের একজন গবেষক বলেন,লেখকের রচনাশৈলীর ওপর লুঙ্গিনাসই প্রথম একটি স্পষ্ট ধারণা প্রদান করেন এবং 'Style is the man himself' এই প্রবচনটির ধারনাও আসলে তাঁরই অবদান।মহত্বব্যঞ্জক রচনাশৈলী যে ভাবের বিশেষত্ব ও ঐশ্বর্যকে একটি শৈল্পিক উচ্চতায় উন্নীত করে,তা তিনি জোর দিয়ে উল্লেখ করেন।
তবে রচনাশৈলিতে পরিমিতির দিকে লক্ষ্য রাখার মানসেই তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেনঃ

'মানুষের শরীরের মতো রচনাশৈলিতেও অহেতুক স্ফীতি গ্রহণীয় নয়।'



সুতরাং লুঙ্গিনাসের সাহিত্য বিষয় মূলবক্তব্য-উৎকৃষ্ট সাহিত্য ও শিল্প তাই যা মানুষকে অনুপ্রাণিত করে।শুধু একবার নয়,যতবার পড়া যাবে ততবার রসাস্বাদন লাভ হবে এবং পাঠক আনন্দ লাভ করে অনুপ্রাণিত হবে। সাহিত্য সম্বন্ধে,সাহিত্যের আদর্শ সম্বন্ধে লুঙ্গিনাসের এ মনোভাব ও বক্তব্য তাকে স্মরণীয় করে রেখেছে।


কোন মন্তব্য নেই

enot-poloskun থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.