তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতি বলতে কী বুঝায়?তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতির পরিধি ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতি বলতে কী বুঝায়?তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতির পরিধি ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা কর
বাংলা সাহিত্য |
উপস্থাপনাঃ
আমাদের দেশে 'সমালোচনা' শব্দটিকে আমরা সাধারণত নিন্দার্থেই বেশি ব্যবহার করি-যা যথার্থ নয়। 'সমালোচনা' শব্দটি ভাঙলে আমরা 'সম' ও 'আলোচনা' এই দুটি শব্দ পাই।সম+আলোচনা=সমালোচনা।শাব্দিক বিশ্লেষণে বোঝা যায়,সমালোচনায় সমানভাবে ভালো ও মন্দ দুটি দিকই আলোচনায় থাকবে।
শিল্পসাহিত্যে সমালোচনা হচ্ছেঃ কোন শিল্পকর্মের উৎকর্ষ অপকর্ষের বিচারমূলক সম্যক আলোচনা। 'সম্যক আলোচনা' বলতে পন্ডিতগণ মনে করেন,যে শিল্পকর্মের সমালোচনা করা হবে তার ভাব,বিষয়বস্তু,গঠনরীতি,বিবিধ অলঙ্কার ব্যবহার এবং লেখকের মানসদৃষ্টি ইত্যাদির বিশ্লেষণ থাকবে।আধুনিক কালে সাহিত্য সমালোচনা বলতে সাহিত্যের গবেষণা,আলোচনা,মূল্যায়ন ও ব্যাখ্যা ইত্যাদির সম্মিলন বোঝায়।সমালোচনা পদ্ধতির সংখ্যা অনেক,এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতি।নিচে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ
তুলনামূলক পদ্ধতি বলতে কী বুঝায়?
তুলনামূলক পদ্ধতি সাহিত্যবিচারের একটি আধুনিক পদ্ধতি বলে স্বীকৃত।
একটি শিল্পকর্মের সঙ্গে অনুরূপ আরেকটি শিল্পকর্মের তুলনা করে সাহিত্যবিচারের বা মূল্যায়নের যে সমালোচনারীতি তার নাম তুলনামূলক পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে তুলনা করা হতে পারে একই দেশের বা একই ভাষার বা সাহিত্যের দুটি সাহিত্যকর্মের মধ্যে,আবার দুটি ভিন্ন ভাষার বা দেশের দুটি বা ততোধিক সাহিত্যকর্মের তুলনা করেও উপকর্ষ বা অপকর্ষ নির্ণয় করা যেতে পারে।
কীভাবে,কার হাত ধরে এই পদ্ধতি রূপ লাভ করে?
জন ড্রাইডেন (১৬৩১-১৭০০) কে তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতির প্রবর্তক বলে মনে করা হয়।পরবর্তী পর্যায়ে ম্যাথু আর্নল্ড এই পদ্ধতিকে যুক্তির ওপর দাঁড় করিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ পদ্ধতিতে পরিণত করেন।
তুলনামূলক পদ্ধতির পরিধি
এই পদ্ধতি অপেক্ষাকৃত আধুনিক।জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসারের ফলে এখন যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষের সঙ্গে অনয প্রান্তের মানুষের।ফলে শজেই মানুষ হাতে পায় বিভিন্ন দেশের সংবাদ,পড়ে ফেলতে পারে ভিন দেশের সাহিত্য।তাই সহজেই আমরা লেখকের ভাবনা,আঙ্গিক,আকাঙ্ক্ষা সব জানতে পারি।আগে এমন সুযোগ ছিল না বলে এমন আলোচনা বা বিচার সম্ভব ছিলো না।ফলে আগে সারাবিশ্বের শিল্পসংস্কৃতির মেলবন্ধনের ক্ষেত্রটিও ছিলো সীমিত।এখন এই বিস্তৃতির ফলে সকলেই উপকৃত হচ্ছেন-যা আশার আলো।
এখন বিশ্বের অনেক ঘটনাই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষকে একই সঙ্গে প্রভাবিত করে।কোন একটি দেশের আন্দোলন, সঙ্কট বা মানবিক কোন বিপর্যয় শুধু নিজের বা পাশের দেশকে নয়,অনেক দূরদেশের কোন সংবেদনশীল মানুষকেও স্পর্শ করে।ফলে একই ঘটনা বা বিষয় নিয়ে সাহিত্য রচিত হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে।একজনের সঙ্গে আরেকজনের পার্থক্য বিস্তর।হয়তো একজন প্রতিবাদী আরেকজন আপোষকামী।কিন্তু একই আবেগের প্রকাশ দেখে আমরা বিস্মিত হই।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জয়দেবের সঙ্গে বিদ্যাপতির,কালিদাসের কুমারসম্ভবের সঙ্গে মিল্টনের প্যারাডাইস লস্টের,কালিদাসের নায়িকা শকুন্তলার সঙ্গে শেকসপিয়রের দুই নায়িকা মিরেন্ডা ও ডেসডিমোনার তুলনামূলক আলোচনা করেন।
তিনি এ সকল আলোচনায় কোথায় কোথায় মিল ও অমিল রয়েছে তা যেমন অনুসন্ধান করেছেন তেমনি তিনি একটি আরেকটিকে কীভাবে কতখানি প্রভাবিত করেছে,তারও একটি রেখাচিত্র অঙ্কন করেছেন।
পরবর্তী সময়ে আরও অনেকেই এ রকম আলোচনা বা গবেষণা করেছেন।মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদ বধ কাব্যে ইলিয়ড,ওডিসি ও রামায়ন,মহাভারতের প্রভাবের কথাতো আমরা জানি।রবীন্দ্রনাথের ওপর কিটসের প্রভাব বা নজরুলের ওপর বায়রনের প্রভাব রয়েছে বলে অনেক লেখাই আমরা দেখতে পাই।
তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতিতে যে দুটো বা তার অধিক বই বা শিল্পের তুলনা করা হবে,সেগুলো অনুরূপ বা সমগোত্রীয় হতে হবে।উপন্যাসের সঙ্গে উপন্যাস,কাব্যের সঙ্গে কাব্যের তুলনা হলে ভালো হয়।একই বিষয়কে অবলম্বন করে দুটো শিল্পী রীতির শিল্পের মধ্যে আলোচনা হতে পারে।এ রকম তুলনামূলক আলোচনায় জীবনাচরণের পার্থক্যের পরও মানবানুভূতির সহজাত আবেগ ও অনুরাগ,সঙ্কট ও সম্ভাবনা ওঠে আসে।এ রকম সমালোচনা এখন পত্র পত্রিকায় দেখা যায়।
ম্যাথু আর্নল্ড (১৮২২-১৮৮৮) সমালোচকের যোগ্যতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেনঃ
তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যসমূহ কী কী?
নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ- ১)সমালোচকদের প্রবণতা অনুসারে দুই দেশের গ্রন্থের মধ্যে সাদৃশ্য স্থাপিত হতে পারে।তুলনামূলক আলোচনার সূত্র ধরে একটির সাহায্যে অপরটিকে বুঝা যায়,এক দেশের সঙ্গে অপর দেশের চরিত্রগত সাদৃশ্য বা বৈপরিত্যও লক্ষ্য করা যায়।
- ২)তুলনামূলক সমালোচনা পদ্ধতিতে পাশ্চাত্য সমালোচক ম্যাথু আর্নল্ড এবং প্রাচ্যের মাইকেল মধুসূদন দত্ত সাহিত্য বিচার সমালোচনায় এ পদ্ধতির উদ্ভাবক।
- ৩)এই পদ্ধতিতে সাহিত্যের ক্ষেত্রে দু'চারজন বহুভাষাবিদ স্রষ্টা ও মনীষী এই তুলনামূলক আলোচনাকে সহজ করে দিয়েছিলেন।
- ৪)এই পদ্ধতিতে তুলনার মাধ্যমে তুলনীয় সাহিত্যগুলোর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য এবং রীতিপদ্ধতিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
- ৫)এই পদ্ধতিতে শিল্পের একটি শাখা সাহিত্য অন্য শাখা চিত্রকরের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে।কাব্য ও সংগীত পারস্পরিক তুলনায় নিজেদের চরিত্র বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলতে পারে।
পরিশেষে বলা যায় যে,তুলনামূলক আলোচনার দ্বারা নানাদেশের সাহিত্য ও রচনাকারের অপরিচয়ের ব্যবধান ঘোচানো সম্ভব হচ্ছে,তাতে সন্দেহ নেই।
কোন মন্তব্য নেই