রিয়েলিজম বা বাস্তববাদ কী উদ্ভব ও বিকাশ আলোচনা কর

রিয়েলিজম বা বাস্তববাদ কী উদ্ভব ও বিকাশ আলোচনা কর

বাংলা সাহিত্যে রিয়েলিজম,রিয়েলিজম,বাস্তববাদ কী
বাংলা সাহিত্য




  রিয়েলিজম রোমান্টিসিজমের বিপরীত সাহিত্যতত্ত্ব,দর্শনতত্ত্ব বা ধারণা । রিয়েলিজম এর বাংলা বাস্তববাদ।শব্দটি দর্শন শাস্রের এবং দর্শনশাস্র থেকে শব্দটি চিত্রকলায় ও সাহিত্যে এসেছে।দর্শন শাস্রে শব্দটি ভাববাদের বিপরীতে ব্যবহার করা হয়।আঠারো শতকের শেষের দিকে শিলার এবং শ্লেগেল নামের দুইজন দার্শনিক শব্দটি ‘External reality’ অর্থে প্রয়োগ করেন।রবীন্দ্রনাথের মতো অনেক ভাববাদী লেখকই সাহিত্যে রিয়েলিজমের প্রবেশ মেনে নিতে চাননি।পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের মতো সকলেই ,রিয়েলিস্টদের লেখা পড়ে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে ,আসলে কোন লেখাই সাহিত্যপদবাচ্য হয় না,যদি না তার মধ্যে ‘মনের যোগ’ বা ‘কল্পনা’ ইত্যাদির সম্পর্ক না থাকে।আর রিয়েলিস্টদের লেখায় যতোই রিয়েলিটি রয়েছে বলে দাবি করা হয়,তাদের মধ্যে কালোত্তীর্ন যারা ,তাদের লেখায় খানিকটা কল্পনা,খানিকটা ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার মিশেল ও আমরা দেখতে পাই।


                                রিয়েলিজম বা বাস্তববাদ উনিশ শতকীয় একটি সাহিত্য আন্দোলন। ১৮৫০ সালে ফরাসি দেশে প্রথম রিয়েলিজম শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায়।

 

  কোন প্রেক্ষাপটে রিয়েলিজম ধারাটি শুরু হয়?

 

ইউরোপের সমাজ তরঙ্গায়িত।আমাদের মতো নিস্তরঙ্গ ও নিষ্প্রান নয়।বিশেষ ঘটনা,বিশেষ বক্তব্য,নতুন কোন দর্শনতত্ত্ব বা নতুন কোন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে।উনিশ শতকের প্রথম দিকে দার্শনিক ক্যোঁৎ (comte) নতুন দর্শন প্রত্যক্ষবাদ (Positivism) প্রচার করলে তা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এই তত্ত্বটি যুক্তিধর্মী ও বিজ্ঞানভাবাপন্ন এবং ভাববাদকে অস্বীকার করে। প্রত্যক্ষণীয় ঘটনাসমূহ এবং তাদের সম্বন্ধের উপর নির্ভরশীল হওয়াই হচ্ছে এই দার্শনিকদের মূল কথা।প্রত্যক্ষবাদের প্রভাব ছাড়াও এই সময়ে আরও কয়েকজন বিজ্ঞানী ও দার্শনিকের মতাদর্শ জনমানসে আলোড়ন তোলে।যেমনঃ এই সময়ে জার্মান দার্শনিক ফয়েরবাগ মানুষকে বিশ্লেষন করেন নতুন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে।

তিনি বলেনঃ


মানুষ নশ্বর এবং এই নশ্বর প্রত্যক্ষ জীবনই চরম সত্য। মানুষের আধ্যাত্মিক কোন শক্তি নেই,আর জীবনের বাইরেও কোন সত্য নেই।


এ সময়ই জীবন বিশ্লেষণের তত্ত্ব দেন সিগমন্ড ফ্রয়েড-যা মানুষের অবচেতন মনকে বিশ্লেষণ করে স্বপ্ন ও যৌনানুভূতির এক বিস্ময়কর সত্য উপস্থাপন করে।

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ডারউইন সৃষ্টি করেন -বিবর্তনবাদ,সকল প্রাণিই বিবর্তিত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এবং সংগ্রাম করে টিকে থাকছে।মানুষ ও একটি প্রাণী সেও প্রাণীর আচরনই করবে।দর্শনের ও বিজ্ঞানের এই দৃষ্টিভঙ্গি পৃথিবীতে নতুন আলো ছড়ায়,নতুন এক মূল্যবোধ জাগায়-যা সকলকিছুই যেমন অর্থনীতিতে শিল্পের প্রসার, পুজিবাদের সর্বগ্রাসী প্রভাব ইত্যাদিকেও নতুন করে,খুব কাছ থেকে বিশ্লেষনের প্রশ্নটি সামনে নিয়ে আসে।এ সকল কারনে শিল্পী ও দার্শনিকগণের চেতনায় জীবন ও জগত সম্পর্কে একটি নির্মোহভাব ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।


তিনজন ব্যক্তি বাস্তববাদী সাহিত্যতত্ত্বের উদ্ভাবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।তারা হলেনঃ

  1. ক)চার্লস ডারউইন
  2. খ)সিগমন্ড ফ্রয়েড
  3. গ)কার্ল মার্কস


    রিয়েলিজমের সংজ্ঞা বলতে আমরা কী বুঝি



রিয়েলিজম বলতে বোঝায় এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি বা মতবাদ যেখানে বাস্তবতাই মুখ্য,বাস্তব পৃথিবীই শিল্পের ভিত্তি-কল্পনা মুখ্য নয়।বাস্তবতাই সত্য।এই সত্যকে কোনরূপ রোমান্টিকতা,ধুম্রজাল,অস্পষ্টতা বা অন্য কোন উপায়ে খানিকটা দেখা ও অদেখার মতো করে সৃষ্টি না করে যথাযথ ও বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রকাশ করার নামই হচ্ছে বাস্তবতাবাদ।


শিল্পী বাস্তবে যা দেখেন,শোনেন সহজবোধ্য করে তাই সাহিত্যে রূপ দেন।জীবনের বাস্তব অবস্থার বিশ্বস্ত ও যথাযথ চিত্রায়নই এখানে প্রধান।এই ধারার শিল্পীগন বাস্তবতাকেই সত্য বলে জানেন এবং মানেন।বাস্তববাদী শিল্পী জীবন,জগত ও প্রকৃতিকে ভাবের আতিশায্যে ,কোন আদর্শের ওপর ভিত্তি করে বা কোন অধ্যাত্মভাবনায় তাড়িত হয়ে উপস্থাপন করেন না। তাদের রচনায় কোন ভাবেই জীবন অতিরঞ্জিত বা বিকৃত নয়। ‘As it actually it’ বাস্তবে যা, হুবুহু তার ছবি প্রদানই এই শিল্পীদের বিশেষত্ব।


বাস্তববাদী উইলিয়াম ডিন হাওয়েলস বলেনঃ


                                            ‘বাস্তববাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রাত্যহিক জগতের মুখোমুখি হওয়া এবং এর কর্মকাতর,চিন্তাক্লিষ্ট সাহসী এবং সদয় অবয়বের চিত্রাঙ্কন।’


বাস্তববাদী লেখকগণ মনে করেন,শিল্পসাহিত্যে বাস্তবতা থাকলে তা মানুষকে আসল রূপটি দেখাতে পারে।আর আসল রূপটি বোঝাতে পারলে বা দেখাতে পারলে,তা থেকে মানুষ সহজেই সত্যকে দেখবে এবং বোঝবে বা বোঝার পথ অনুসন্ধান করবে।



  রিয়েলিজম ধারার সূত্রপাত করেন কারা


ফরাসি ঔপন্যাসিক ওন’ রে দ্যা বালজ্যাক (১৭৯৯-১৮৫০) কে সাহিত্যে রিয়েলিজমের প্রবর্তক বলে মনে করা হয়।তিনি তার উপন্যাস ‘লা কমেডি হিউমেইন’ মধ্য দিয়ে এ মতবাদ এর প্রচার শুরু করেন।সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপন-সমাজবাস্তবতার এক নিখুঁত অনবদ্য দলিল।


পরবর্তীতে আরেক ঔপন্যাসিক Champfleury এর ‘লে রিয়েলিজম’ (১৮৫৭) প্রকাশিত হলে একদল লেখক আনুষ্ঠানিকভাবে রিয়েলিজম নামে নতুন গোষ্ঠীর গোড়াপত্তন করেন।

উনিশ শতকের শেষভাগে ও বিশ শতকের প্রথম দিকে ফরাসি দেশে সাহিত্যের অন্যতম শাখা নাটকে এই রিয়েলিজমের প্রকাশ নানাভাবে লক্ষ্য করা যায়।ইংল্যান্ডে জর্জ ইলিয়ড রিয়েলিজমের ধারাকে পাঠকের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন।আমিকায় পরিচিত হয় নাট্যকার ইউজিন ও নিল (১৮৮৮-১৯৫৩) আর্থার মিলার (১৯১৫-১৯৪৯) প্রমুখ ব্যক্তিদের মাধ্যমে।  


ঊনবিংশ শতকের ফরাসি,রুশ ও ইংরেজি সাহিত্যের বাস্তববাদীদের যে বৈশিষ্ট্য বা স্বভাবধর্ম তাদের রচনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হচ্ছে-


  1. ক)বিশ্লেষণ প্রবণতাই বাস্তববাদী সাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
  2. খ)প্রেম ও পুজির দ্বন্দ্বের নিখুঁত ছবি এঁকেছেন এরা।
  3. গ)ব্যক্তির সাথে তার পরিবেশের দ্বন্দ্ব এঁদের রচনার প্রধান উপজীব্য।
  4. ঘ)ধনতন্ত্রের চাপে ব্যক্তি হৃদয়ের যন্ত্রণার ভাষ্যকার এই বাস্তববাদীরা।
  5. ঙ)বর্ণ্নায় যথাযথতা বজায় রাখতে চেয়েছেন বাস্তববাদীরা।



পরিশেষে বলা যায় যে,রিয়েলিজম আন্দোলন শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সাহিত্যে সাধারন মানুষের বাস্তব জীবন ফুটে উঠতে শুরু করে।রিয়েলিজম বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দ্বারা আচ্ছাদিত।বাস্তববাদ সাহিত্যতত্ত্ব শিল্প সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে,কারণ এটি মানবজীবন সম্পর্কিত-আর শিল্প সাহিত্য তো মানব নির্ভর একটি বিষয়।


কোন মন্তব্য নেই

enot-poloskun থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.