'সাত সাগরের মাঝি' কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বর্ণনা কর

 'সাত সাগরের মাঝি' কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বর্ণনা কর

বাংলা সাহিত্যে সাত সাগরের মাঝি
বাংলা সাহিত্য



উপস্থাপনাঃ
নামের মধ্য দিয়েই কোন কিছুর সাথে আমাদের প্রাথমিক পরিচয় ঘটে।শিরোনাম হলো শনাক্তকারী প্রতীক।নামের মাধ্যমে ব্যক্তি বস্তু বা শিল্পকর্ম বা যেকোন বিষয়ের মৌল বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়।শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রে নামকরণ ও আর্টের অন্তর্ভুক্ত।উৎকৃষ্ট নামকরণ আয়নার মতো শিল্পের মূল উপজীব্য প্রতিফলিত করে।এ কারণেই সার্থক সাহিত্যকর্মের অন্যতম শর্ত অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ নামকরণ । কবি সাহিত্যিকগণ কাব্যের মূলভাব,অন্তর্নিহিত তাৎপর্য,রূপক বা প্রতীকধর্মিতা,তাঁর জীবনদৃষ্টি প্রভৃতির আলোকে সাহিত্যকর্মের নামকরণ করেন।

নামকরণের সার্থকতাঃ
'সাত সাগরের মাঝি' ফররুখ আহমদের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ।এটি তাঁর সর্বাধিক আলোচিত ও সর্বাধিক জনপ্রিয় গ্রন্থ। ১৯৪৪ সালে এটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাব্যামোদী মহলে বিপুল সাড়া পড়ে যায়।কবি হিসেবে তাঁর খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা ও নিশ্চিত হয়। 'সাত সাগরের মাঝি' কবি হিসেবে ফররুখ আহমদের বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্যকে সুস্পষ্ট করে তোলে।এটি ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ হিসাবে যেমন পরিচিত তেমনি বাংলা সাহিত্যের ও অন্যতম উল্লেখযোগ্য সংযোজন হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

'সাত সাগরের মাঝি' কাব্যগ্রন্থে মোট ১৯ টি কবিতা সংকলিত হয়েছে।এছাড়া এ কাব্যটি উৎসর্গ করা হয়েছে উপ-মহাদেশের খ্যাতিমান দার্শনিক কবি ইকবালকে।এ কাব্যের অন্তর্ভুক্ত ১৯ টি কবিতা হচ্ছে-
সিন্দবাদ,বা'র দরিয়ায়,দরিয়ার শেষ রাত্রি,শাহরিয়ার,আকাশ-নাবিক,বন্দরে সন্ধ্যা,ঝরোকা,ডাহুক,এই সব রাত্রি,পুরানো মাজারে,পাঞ্জেরী,স্বর্ণ-ঈগল,লাশ,তুফান,হে নিশান-বাহী,নিশান,নিশান-বরদার,আউলাদ,সাত সাগরের মাঝি।বিষয়বস্তুর দিক থেকে এ কবিতাগুলোকে প্রধানত তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়।
  1. প্রথমত, নিসর্গমূলক
  2. দ্বিতীয়ত, সমুদ্র যাত্রা বিষয়ক
  3. তৃতীয়ত, পুনর্জাগরণ মূলক।
এ তিন শ্রেণীর কবিতার ভাব ও বিষয় যেমন ভিন্ন,তেমনি এতে ব্যবহৃত শব্দের মধ্যেও পার্থক্য দেখা যায়।যেমন ডাহুক কবিতার মধ্যে আরবি-ফারসি শব্দ নেই বললেই চলে।অন্যদিকে,সাত সাগরের মাঝি শীর্ষক কবিতায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।ভাব-বিষয় ও পরিবেশের বর্ণনাকে বাস্তবসম্মত করে তোলার জন্যই মূলত উপযোগী ভাষা ব্যবহারের প্রয়াস।যথোপযুক্ত ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে ফররুখ আহমদ অনন্যসাধারণ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন।এটা তারই প্রমাণ। 

ফররূখ আহমদের উপর লেখা সর্বপ্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের রচয়িতা ডক্টর সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায় ভাব ও বিষয়বস্তুগত দিক বিচার করে 'সাত সাগরের মাঝি' কাব্যের অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলোকে মোট চার ভাগে বিভক্ত করে এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন।তাঁর এ শ্রেণী বিভাগগুলো যথার্থ মনে হয়।এগুলো নিম্নরূপঃ
  1. ১। ইসলামী ভাব,ঐতিহ্য ও জাতীয় জাগরণমূলক কবিতা।
  2. ২। বাস্তব অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ কবিতা।
  3. ৩। রোমান্টিক কবি-চিত্তের ব্যাকুলতা বিষয়ক কবিতা।
  4. ৪।প্রেম-বিষয়ক কবিতা।

  1. প্রথম বিভাগের অন্তর্ভুক্ত কবিতাগুলো হচ্ছে-সিন্দবাদ,বা'র দরিয়ায়,দরিয়ার শেষ,রাত্রি,আকাশ-নাবিক,বন্দরে সন্ধ্যা,এই সব রাত্রি,পুরানো মাজারে,পাঞ্জেরী,স্বর্ণ ঈগল,তুফান,হে নিশানবাহী,নিশান,নিশান বরদার ও সাত সাগরের মাঝি।
  2. দ্বিতীয় বিভাগের কবিতা গুলো হচ্ছে- লাশ ও আউলাদ।
  3. তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত হচ্ছে- ডাহুক।
  4. চতুর্থ শ্রেনীভুক্ত হচ্ছে-শাহরিয়ার ও ঝরোকা।

ইসলামী ভাব,ঐতিহ্য ও জাতীয় জাগরণমূলক কবিতা রয়েছে চৌদ্দটি।সাত সাগরের মাঝি কাব্যের অধিকাংশ কবিতা এ শ্রেণীভুক্ত।এ কাব্যের মূল ভাব,বিষয় ও আবেদন প্রধান্ত এ কবিতাগুলোকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে।প্রথম তিনটি কবিতা ও শেষের কবিতাটি সমুদ্র বিষয়ক কবিতা।এ কবিতাগুলো একদিকে যেমন ইসলামী ঐতিহ্য ও জাতীয় জাগরণমূলক,তেমনি তা সমুদ্র-অভিযান বিষয়ক।কাব্যের মূল ভাব ও বিষয়কে যথাযথরূপে উন্মোচিত করার লক্ষ্যে কবি সমুদ্র অভিযানের বর্ণনা দিয়েছেন।প্রাক ইসলামী যুগে আরব মুসলিমগণ সমুদ্র পথে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্য করতেন।বাণিজ্য পণ্যের সাথে ইসলামের সওদা নিয়ে তারা বিশ্বব্যাপী বিচরণ করেছেন।বাণিজ্যের সাথে সাথে ইসলামের দাওয়াত ও তারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছেন।তাই সমুদ্র অভিযানের সাথে কবির ভাব-কল্পনা অনেকটা অবিচ্ছিন্ন বিষয়।

ফররুখ আহমদের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান হচ্ছে এই যে,তিনি সিন্দবাদ কাহিনীকে রূপক ও প্রতীকের মাধ্যমে বযবহার করেছেন।এখানে সিন্দবাদকে কবি অতীত গৌরব যুগের কর্মচঞ্চল,প্রাণোচ্ছল,দুঃসাহসী ও প্রত্যয়দৃপ্ত বিশ্ব-বিজয়ী মুসলিম জাতির প্রতীকরূপে সমুপস্থিত করেছেন।সিন্দবাদ কাহিনীর প্রতীকী আধারে কবি মুসলমানদের অতীত গৌরবময় দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদেরকে আত্ম শক্তিতে বলীয়ান ও নবজাগরণের মন্ত্র উদ্দীপ্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।কবি যে 'নোনা দরিয়ার ডাক' শুনতে পেয়েছেন তা তিনি সমগ্র মুসলিম জাতির প্রাণ-মূলে ছড়িয়ে দিতে চান-সিন্দবাদের মতই দুর্দমনীয়  প্রাণাবেগে চঞ্চল হয়ে 'নতুন পানিতে' নতুন জীবনের অভিযাত্রায় মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধ করে তুলতে চান।কবি তাই বলেনঃ

কেটেছে রঙিন মখমল দিন,নতুন সফর আজ,
শুনছি আবার নোনা দরিয়ার ডাক,
ভাসে জোরওয়ার মউজের শিরে সফেদ চাঁদির তাজ,
পাহাড়-বুলন্দ ঢেউ বয়ে আনে নোনা দরিয়ার ডাক;
নতুন পানিতে সফর এবার,হে মাঝি সিন্দবাদ!

পাঞ্জেরী কবিতায় ঐতিহ্য চেতনা ও অতীত-চিন্তার সাথে বর্তমানের ভাবনা-কল্পনা যেন একসূত্রে গ্রথিত হয়েছে।প্রতীকী কল্পনার মাধ্যমে কবি এখানে ইসলামী পুনরুজ্জীবনের অন্তরঙ্গ আবেদন ব্যক্ত করেছেন।অন্ধকার সাগরের বুকে জাহাজের যাত্রীরা নব ঊষার আলোর প্রতীক্ষায় যেমন অধীর,চঞ্চল হয়ে ওঠে,অধঃপতিত মুসলিম জাতির জীবনেও তেমনি তিমির রজনীর অবসান হয়ে কবে আলোকোজ্জ্বল দিনের আবির্ভাব হবে-কবি তারই প্রতীক্ষায় অধীর প্রহর গুণছেন।কবি বলেছেনঃ

রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা,হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তুলে,আমি দাঁড় টানি ভুলে,
অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।
রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী?

'সাত সাগরের মাঝি' কাব্যের সর্বশেষ কবিতার নাম 'সাত সাগরের মাঝি'।এটি এ কাব্যের নাম কবিতা এবং এ কবিতাটিকে শুধু এ কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবিতা বলাই যথেষ্ট নয়। এটা ফররুখ আহমদের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য কবিতা।কবিতার শুরুতেই কবির বর্ণনাঃ

কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হলো জানিনা তা।
নারঙ্গী বনে কাঁপছে সবুজ পাতা।
দুয়ারে তোমার সাত সাগরের জোয়ার এনেছে ফেনা।
তবু জাগলে না? তবু তুমি জাগলে না?


পরিশেষে বলা যায় যে,ফররুখ আহমদের অপর কাব্যে যেমনই হোক, 'সাত সাগরের মাঝি' কাব্যে অতীতকে নবমূল্যে উদ্ভাসিত করে ভবিষ্যতের পথনির্দেশ দানের বিষয়টি লক্ষ্য করা যায়।তিনি তাঁর কাব্যে মুসলমান সমাজের জন্য একটি গৌরবময় ,উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছেন।তাঁর বিশ্বাস,ইসলাম একটি শাশ্বত কল্যাণকর মানবিক আদর্শ,যা সর্ব যুগে সর্ব দেশে মানুষের জীবন সমস্যা সমাধানে সহায়ক।সাহিত্যের মধ্য দিয়ে তিনি এ আদর্শের স্বপ্নোজ্জ্বল রূপের ধ্যান করেছেন,তার অবিচল বিশ্বাসের কথা সকলকে জ্ঞাত করেছেন।সার্বিক বিচারে বলা যায় সাত সাগরের মাঝি নামকরণটি সার্থক হয়েছে।

কোন মন্তব্য নেই

enot-poloskun থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.