হোরেসের "আর্স পোয়েটিকা" অবলম্বনে তাঁর সাহিত্য ও কাব্য ভাবনার পরিচয় দাও. অথবা, হোরেসের সাহিত্যতত্ত্বের বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী? আলোচনা কর।

 হোরেসের "আর্স পোয়েটিকা" অবলম্বনে তাঁর সাহিত্য ও কাব্য ভাবনার পরিচয় দাও
অথবা, হোরেসের সাহিত্যতত্ত্বের বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী? আলোচনা কর।

বাংলা সাহিত্যে হোরেসের আর্স পোয়েটিকা
বাংলা সাহিত্য



গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের পরেই সাহিত্যত্ত্ব আলোচনায় যার নাম শ্রদ্ধার সাথে উল্লেখ করা হয়ে থাকে তিনি হলেন হোরেস (খ্রিষ্টপূর্ব ৬৫-৮)। প্রাচীন রোমান সমালোচকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।যদিও তিনি গ্রিক সাহিত্যের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন এবং প্লেটো এরিস্টটলের পথ ধরেই চলেছেন,তবু পরিমিত ক্ষেত্রে সাহিত্যতত্ত্ব বিচারে কিছু নতুন কথা বলেছেন।তাই সাহিত্য সমালোচনার ধারায় এরিস্টটলের পর তাকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং তাঁর "আর্স পোয়েটিকা" গ্রন্থটি সমালোচনাতত্ত্ব বা কাব্য নির্মাণ তত্ত্ববিষয়ক গ্রন্থ হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়।


ল্যাটিন ভাষা ও সাহিত্যের বহুমাত্রিক অমর গীতিকবি এবং ল্যাটিন সমালোচনা সাহিত্যতত্ত্বের পথপ্রদর্শক ও গৌরব হোরেস।তাঁর  পুরো নাম Quintas Horatius Flaccus (কুইন্টাস হোরেসিয়াস ফ্ল্যাক্কাস)৷ 'ওডস' ও 'এপিস্টেলস' নামক পত্র কবিতার মাধ্যমে তাঁর খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।তবে যে সাহিত্যের মাধ্যমে তাঁর প্রসিদ্ধি,তা হলো তাঁর সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ ' আর্স পোয়েটিকা'।

'আর্স পোয়েটিকা' একটি ছোট্ট বই- যা চিঠির আকারে কবিতার ছন্দে লেখা।মোট ৪৭৬ টি পঙক্তি। জনৈক লুসিয়াস ক্যালপুর্নিয়াস পিসো ও তাঁর বড় ছেলেকে উদ্দেশ্য করে চিঠিটি লিখেন। এ গ্রন্থে হোরেস ছন্দরীতিতে সাহিত্যতত্ত্ব  ও কাব্যতত্ত্ব আলোচনা করেছেন। এরিস্টটলের 'পোয়েটকস' এ যা বলা হয়েছে হোরেস তার বেশি কিছু বলতে পারেননি।কিন্তু তাঁর বলার ভঙ্গিটি ছিল স্বতন্ত্র ও কবিসুলভ।হোরেস কবি হিসেবে যে সমস্যা অনুভব করেছেন,তাই বলার চেষ্টা করেছেন।তাঁর এই বক্তব্য সাহিত্য গুন সমৃদ্ধ ছিলো বলে তা জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।বক্তব্য উপস্থাপনে তাঁর অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় রয়েছে-যা কোন নবীন লেখককে পথ দেখাতে সাহায্য করতে পারে।

তিনি এ গ্রন্থে কখনো নাটকের কথা এবং নাটকের বিভিন্ন ফর্মের কথা যেমন ট্রাজেডি, কমেডির কথা,কখনো কবিতার কথা,কখনো সংগীতসৃষ্টির কথা বলেছেন।এতে অবশ্য কোনো ধারাবাহিক বৈজ্ঞানিক রীতিতে সাহিত্যতত্ত্ব আলোচিত হয়নি।মূলত শিক্ষার্থীদের প্রতি উপদেশ দিতে গিয়ে হোরেস বিচ্ছিন্নভাবে কবিতা,রচনাকৌশল, ভালো লেখকের গুণগত বৈশিষ্ট্য, প্রথম শিক্ষার্থীর সাহিত্য পাঠের ভূমিকা প্রভৃতি আলোচনা করেছেন।
হোরেসের চিঠিটি বিশ্লেষণ করে কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন গবেষকগণ।যেমনঃ

১)সাহিত্যের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ
সাহিত্যের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্ধারণে হোরেস প্রথম জোর দিয়েছেন জীবনের প্রতি এবং জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু উপস্থাপনের প্রতি।তিনি বলেছেন-
কবির লক্ষ্য হতে পারে আনন্দ দান অথবা কোন উপযোগ সৃষ্টি তথা আনুকূল্য প্রাপ্তি।'আত্মার তৃপ্তি' বা আনন্দ দানের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন,তাও যেন অবশ্যই জীবনানুগ হয়।অর্থাৎ বাস্তবতাবর্জিত বা জীবনবিমুখ কোন কিছুকে ভিত্তি করে আত্মতৃপ্তি বা আনন্দ দানের পক্ষে তিনি মত দেননি।হোরেস মনে করেন,আনন্দ ও শিক্ষাদান দুটোকে একসাথে মিলাতে পারলে নাট্যকার খ্যাতির শিখরে আসন পেতে পারেন।তিনি শিক্ষা ও আনন্দকে সমান গুরুত্ব দিয়েছেন।তাঁর ভাষায়-

"যারা একই সাথে কিছু প্রাপ্তি এবং আনন্দের
সংমিশ্রণ ঘটাতে পারেন তারাই সবার অনুমোদন
লাভে সমর্থ হন।কারণ তাঁরা পাঠককে একই সাথে আনন্দ ও শিক্ষা দেন।
এ ধরনের বই শুধু ব্যবসায়ীদের লাভই বাড়ায় না,বরং দেশ বিদেশে সুনাম বয়ে বেড়ায় এবং লেখকের জন্য স্থায়ী খ্যাতি এনে দেয়।"


২)সাহিত্যের বিষয়ঃ
হোরেসের মতে,সাহিত্যের বিষয় সাহিত্যস্রষ্টার মনননির্ভর।অসাধারণ কালজয়ী মন্তব্য হোরেসেরঃ
'মননের গভীরতাই উন্নত রচনার ভিত্তি ও উৎস।' হোরেস তাই বিষয় নির্বাচনে শিল্পী কে তার সামর্থের ওপর নির্ভর করতে বলেছেন। কারণ সকলের চিন্তা-ভাবনা ও মনন এক রকম নয়। আবার সকল বিষয়েই সকলে গভীর জ্ঞান রাখে না। তাই তিনি সাহিত্য স্রষ্টার মনন ও আগ্রহের ওপর জোর দিয়ে বলেনঃ
কোনটা তোমার যোগ্যতার মধ্যে আর কোনটা বাইরে সে সম্পর্কে গভীরভাবে ভাববে।

বাস্তব জীবনকেই হোরেস শিল্পের বিষয় বলে মনে করেন। তিনি সমাজের দায় দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন বিষয়কে উপস্থাপনের কথা বলেছেন। 'কোন অপরিচিত এবং বিগত কোন বিষয়কে কাব্যে রূপ দেওয়ার চেয়ে' লেখোকের ধরাছোঁয়ার মধ্যে, তার সামর্থের মধ্যে, তার জীবনের সাথে সম্পৃক্ত কোন বিষয়কেই হোরেস সাহিত্যের উপযুক্ত বিষয় বিবেচনা করেছেন। তিনি সে চরিত্র উপস্থাপন করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন, যাতে সত্যশীলতা আছে।এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য হচ্ছেঃ

"তোমরা যারা লেখক হতে চাও, তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী বিষয় নির্বাচন করবে। কোনটা তোমাদের যোগ্যতার মধ্যে আর কোনটা বাইরে সে সম্পর্কে গভীরভাবে ভাববে। যিনি নিজের ক্ষমতার মধ্যে থেকে   বিষয় নির্বাচন করবেন তার ভাষায় ঘাটতি পড়বে না, বরং তার ভাবনা হবে স্বচ্ছ এবং সুবিন্যস্ত। "


৩)শিল্পের ঐক্যঃ
কল্পনার স্বাধীনতা থাকলেও সকল শিল্পীকেই কল্পনার ঐক্য মেনে শিল্প রচনা করতে হবে। উপকরণসমূহের ঐক্য না মেনে 'ঘোড়ার গলায় মানুষের মাথা' বা 'সুন্দরী রমণীদেহের কটিদেশ পর্যন্ত মানুষের আকার রেখে শেষটায় এক কুৎসিত মাছের লেজ জুড়ে দিলে' যেমন নতুন কোনো চরিত্র নির্মাণ করে সাহসের সাথে মঞ্চে উপস্থাপন করতে হলে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যেন এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সঙ্গতিপূর্ণ হয় হাসির উদ্রেক করবে, তেমনি নাটকের কাহিনীর শুরু,মধ্য ও শেষ-এই তিনটি ভাগের মধ্যে ঐক্য না থাকলে তা হবে শিল্পগুণ বর্জিত।

হোরেসের সাহিত্য সমালোচনার যে নীতিটি সর্বাধিক গুরুত্ব লাভ করেছে তা হল শিল্পের ঐক্য ও সংহতি। হোরেসের ভাষায়ঃ
কোন অপরীক্ষিত বিষয় অথবা নতুন কোনো চরিত্র নির্মাণ করে সাহসের সাথে মঞ্চে উপস্থাপন করতে হলে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যেন এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সঙ্গতিপূর্ণ হয়।


৪)রচনারীতিঃ
হোরেস সাহিত্য নির্মাণ তত্ত্ব ও সমালোচনায় প্রাচীনপন্থী হলেও রচনারীতি সম্বন্ধে নতুন ও আধুনিক মনোভাবের স্বাক্ষর রেখেছেন। রচনা রীতিতে শিল্পীর রচনাকৌশল, পদ্ধতি ও প্রকাশভঙ্গির সঙ্গে বিবেচনায় আসে কাহিনির বিন্যাস, শব্দপ্রয়োগ, ছন্দ ইত্যাদিতে শিল্পীর কৃতিত্ব। বিষয়বস্তু নির্বাচনের পর শিল্পীর কাজ হচ্ছে তা সুন্দর ভাবে প্রকাশ করা। যথাযথভাবে প্রকাশ হলে বিষয়টি শিল্পে পরিণত হয়। প্রকাশের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত বিন্যাস,শব্দ ও ছন্দের প্রয়োগ।

হোরেস নিজে কবি ছিলেন। তাই কবি হিসেবে শব্দের ব্যবহার নিয়ে তাঁর ছিলো নিজস্ব ও বাস্তব একটি অভিজ্ঞতা। সে অভিজ্ঞতার প্রকাশ দেখা যায় এই আর্স পোয়েটিকায়।তিনি সবচেয়ে বেশি বলেছেন শব্দপ্রয়োগ নিয়ে।

তাঁর মতে,সাহিত্যের মূলকথা প্রকাশ,কিন্তু ক্রমাগত মানুষের অভিজ্ঞতা বদলাচ্ছে,ফলে কাব্য সাহিত্যের প্রকাশের
ভাষাও বদলাচ্ছে,ফলে কাব্য সাহিত্যের প্রকাশের ভাষা ও বদলাতে পারে।কারন মানুষের ভাষা অভিজ্ঞতা কেই বুনন করে।

তিনি আরো বলেন,
কাব্য যেন গাছ,আর শব্দ পাতা।পুরনো পাতা ঝরে গিয়ে গাছে নতুন পাতা গজায়,তেমনি কাব্যেও পুরনো শব্দ লোপ পেয়ে গিয়ে নতুন শব্দ আবির্ভূত হয়।

৫)শিল্প নৈপুন্যঃ
শিল্প নৈপুণ্য লেখকের অন্তর্নিহিত গুণ।হোরেস লেখক এর শিল্প নৈপুণ্য কে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। সাহিত্যকর্মটিকে নিপুন করতে হলে হোরেস মনে করেন, লেখককে একই সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হবে কাহিনী নির্মাণে, চরিত্র সৃষ্টিতে, শব্দ ব্যবহারে এবং সমন্বয় করতে হবে অভিজ্ঞতা ও জীবনদৃষ্টির মর্মার্থের সঙ্গে।হোরেস মনে করেন, শিল্পীর নৈপুণ্য ও দক্ষতাই শিল্পীকে ব্যতিক্রমী করে তোলে, নিভে যাওয়া আগুনের ধোঁয়া থেকে আগুন জ্বালানোর প্রেরণা জাগায়, চমক লাগানোর পথ বের করে। এজন্য তিনি শিষ্যদের বলেছেনঃ

তুমি যদি কবিতা লেখ তাহলে লক্ষ্য রাখবে মেকি ভক্তের মতো সূক্ষ্ম খেকশিয়াল চালাকি দিয়ে যেন তুমি প্রতারিত না হও।


৬)প্রতিভা ও চর্চাঃ
শিল্পের প্রতিভা সহজাত হলেও হোরেস মনে করেন, 'চর্চাহীন কোন সহজাত প্রতিভাও মূল্যহীন।' ফলে তিনি কবিকে ধৈর্যের সঙ্গে, একাগ্রতা নিয়ে অবিরাম চর্চা করার পরামর্শ দিয়েছেন। জেনে নিতে বলেছেন,'কাব্যনির্মাণের সুনির্দিষ্ট রীতিনীতি।' সাবধান না থাকার কারণে মানুষ ভুল করে, মন যা চায় তা প্রকাশ করতে পারেনা। এমন ক্রুটিকে হোরেস ক্ষমা করার পক্ষপাতী।বার বার অনুশীলনে দোষ-ক্রুটি দূর করা সম্ভব।আর বার বার সুযোগ পেয়েও যে কবি সংশোধনে ব্যর্থ তাকে হোরেস ক্ষমা করতে চাননি।

৭)সমালোচনাঃ
সমালোচনা প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলেনি হোরেস।তবে একটা ধারণা পাওয়া যায়।হোরেস পিসোর পুত্রদের বলেছেন,তোমরা কিছু লিখলে সমালোচক মাইসিয়াসকে, তোমার বাবাকে এবং আমাকে শোনাবে।তারপর নয় বছরের জন্য কাগজগুলো দূরে সরিয়ে রেখো।
এই ছেলেদের বাবা যেহেতু লেখক তাই তিনি, তাদের বাবা এবং একজন সমালোচককে লেখা দেখাতে বলেছেন। কারণ প্রকাশের আগেই সংশোধন হওয়া উচিত।আর নয় বছর দূরে সরিয়ে রাখবে মানে হচ্ছে,কয়েক বছর পর আবার লেখাটি পড়লে ভুলক্রুটি বোঝা যাবে এবং পরিমার্জন-সংশোধনের পর তা সুন্দর হবে।

সুতরাং পরিশেষে বলা যায় যে, এভাবেই হোরেস সাহিত্যতত্ত্বের নানাগুণ বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। সমালোচনায় তিনি প্রাচীনপন্থী হলেও কখনও রক্ষণশীল ছিলেননা। সর্বক্ষেত্রে তিনি পূর্ববর্তী গ্রিক ও রোমানীয় পথেরই অনুসারী ছিলেন। নবীন লেখকদের প্রতি উপদেশ দিয়েছেন- গ্রীক আদর্শের অনুকরণ করে। তিনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সাহিত্য তত্ত্ব আলোচনা করেননি মূলত নবীন শিক্ষার্থীদের প্রতি উপদেশ দিতে গিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কবিতা রচনার কৌশল ভালো লেখক এর গুণগত বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন ।

কোন মন্তব্য নেই

enot-poloskun থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.