বাস্তববাদের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো
রিয়েলিজম বা বাস্তববাদের স্বরূপ ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করো
উনিশ শতকের মাঝামাঝি যখন ইউরোপে ‘রিয়েলিস্টিক’ আন্দোলন শুরু হয় তখন কোনো নির্দিষ্ট গ্রহণযোগ্য নীতি-নিয়ম মেনে এই আন্দোলন শুরু হয়নি।কী বিষয়,কী উপস্থাপনারীতি কোন দিক থেকে এই আন্দোলনের সাহিত্যকে রিয়েলিস্টিক বলা যাবে সে বিষয় কোন স্পষ্ট ধারণা ছিল না।ফরাসি সাহিত্যে ফ্ল্যবেয়ার,বালজাক এবং মোপাসা প্রমুখ কথাসাহিত্যিকদের রচনার মঢ্যে বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির অনেক পার্থক্য থেকে গেছেতেমনি বাস্তববাদী লেখক শেরউড অ্যান্ডারসন এবং জন স্টেইনবেকের রচনাশৈলীর মধ্যেও যথেষ্ট পার্থক্য থেকে গেছে।
রিয়েলিজম শব্দটির যে অর্থ তাতে তার লক্ষণগুলো কেবিল উনিশ বা বিশ শতকের সাহিত্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না।ড্যানিয়েল ডিফো-র ‘মল ফ্লানডার্স’ এবং বেন জনসন এর ‘বার্থালোমিউ ফেরার’ এর কাহিনির মধ্যেও পাওয়া যায়।সাধারণভাবে উনিশ বা বিশ শতকের আগেকার সাহিত্যে,বিশেষ করে কথাসাহিত্যে সাধারণ অশিক্ষিত মানুষের সংলাপ ও আচার-আচরণের নিখুঁত অনুসরণের মধ্যে রিয়েলিস্টিক বা বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়।
রিয়েলিজম বলতে বোঝায় এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি বা মতবাদ বা প্রবণতা যেখানে বাস্তবতাই মূখ্য ,বাস্তব পৃথিবীই শিল্পের ভিত্তি-কল্পনা মুখ্য নয়।শিল্পী বাস্তবে যা দেখেন,শোনেন সহজবোধ্য করে তাই সাহিত্যে রূপ দেন।জীবনের বাস্তব অবস্থার বিশ্বস্ত ও যথাযথ চিত্রায়নই এখানে প্রধান।এই ধারার শিল্পীগণ বাস্তবতাকেই সত্য বলে জানেন এবং মানেন।
রিয়েলিজম এর বৈশিষ্ট্যঃ
- ১)রিয়েলিজম তথা বাস্তববাদ সর্বদা বাস্তবতাকে প্রাধান্য দেয়।বাস্তবতাকে কোন রকম রোমান্টিকতা,আধ্যাত্মিকতা বা আলো-আধারি করে আড়াল করতে চায় না।দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয়বস্তু,চেনা জানা বা পরিচিত কোন ঘটনা বা অভিজ্ঞতাকে স্পষ্টভাবে আবেগহীনভাবে উপস্থাপন করে।বাস্তবতার উন্মোচনই তাদের লক্ষ্য।
- ২)এই ধারার শিল্পীগণ বস্তুকেই প্রাধান্য দেন।কারণ তারা মনে করেন বস্তুর স্থান আগে এবং বস্তু থেকেই চেতনার উজ্জীবন।তাই বস্তুকে ঘিরে অতিরিক্ত রং লাগানো তাদের কাজ নয়।
- ৩)এ শ্রেণির লেখায় বিষয় ও প্রকাশভঙ্গি-সকলস্তরেই থাকে আবেগহীন দৃষ্টিভঙ্গি।কবিতায় শব্দ,উপমা ইত্যাদিতে থাকে যেমন তীর্যকতা তেমনি গদ্য সাহিত্যের ক্ষেত্রে কাহিনি চয়নে,চরিত্র নির্মাণে থাকে নিরেট বাস্তবতা।
- ৪)এই ধারার লেখকগণ শিল্পসৃষ্টির খাতিরে অলঙ্কারে অলঙ্কারে রচনাকে ভারি করে তুলেন না তাদের রচনা।এই ধারার লেখকগণ প্রাত্যহিকভাবে মুখোমুখি হন এবং ‘যা দেখেন’ তাই তারা তুলে ধরেন রচনায়। বাঁদরকে লেজসহই আকেন তারা।অসুন্দর লাগে বলে লেজটিকে বাদ দেও্যার পক্ষে নন তারা।দরিদ্রের জীবনের অসঙ্গতি ও বেদনা যেমন আকেন তেমনি শোষক বা ধনীর দুলালের বল্গাহীনজীবন,অনাচারের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেও্যার চিত্রও আঁকেন যথাযথভাবে।
- ৫)বিশ্লেষণ প্রবণতা এই শ্রেণির লেখকদের বৈশিষ্ট্য।এ জন্যে তাদের লেখা মানুষ,প্রকৃতি ও ইতিহাসের কোন কালের বা কোন সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে এই ধারার লেখা।
- ৬)অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে,সমাজ পরিবর্তনের জন্য কাজ করার অঙ্গীকার।এ জন্য তারা আবিষ্কার করতে চান মানবসমাজের উন্নতির সূত্র।তারা মনে করেন,বাস্তবতার উপস্থাপনে মানুষ সত্য জানবে,বঞ্ছনার কারণ জানবে এবং তার পরিবর্তনের জন্য এগিয়ে আসবে।ফলে উন্নত হবে মানবসমাজ।
- ৭)এই শ্রেণির লেখা মেদবহুল হয় না।অতিরিক্ত কথা,অপ্রাসঙ্গিক সংযোজন সকল সময় বর্জন করা হয়।
- ৮)এই বাস্তবতা তথ্যের বাস্তবতা নয়-রূপের বাস্তবতা।সাহিত্যকর্মী তার প্রতিভা দিয়ে বাস্তবতাকে আবেগ ও অনুভূতি দিয়ে সংশ্লেষ করে শৈল্পিক করে তুলেন।
- ৯)লেখাটি কেমন হওয়া উচিত বাস্তববাদী শিল্পীদের অনেকেই এমন প্রশ্নের উত্তর দেন না।যা হয়েছে,যা ঘটেছে বা যা দেখেছেন,তা তুলে ধরাই এ শ্রেণীর শিল্পীর কাজ।
- ১০)বিষয়বস্তুকে প্রাধান্য দেন বলে তারা ফর্মকে বিশেষ গুরুত্ব দেন না।
- ১১)তারা মনে করেন,তারা যা চোখ দিয়ে দেখবেন,তাই লিখবেন।কিন্তু মন থজাকবে নিষ্ক্রিয় অর্থাৎ পক্ষপাতহীন।
- ১২)ব্যক্তির সঙ্গে পরিবেশ বা সমাজব্যবস্থার দ্বন্দ্ব তাদের লেখায় বেশি লক্ষ করা যায়।
- ১৩) পুজিবাদের ক্রমিক চাপে মানবহৃদয়ের বহুমাত্রিক যন্ত্রণা তাদের লেখায় প্রত্যক্ষ হয়ে উঠেছে।
- ১৪)বাস্তব সত্য চিত্রায়নের নামে এদের রচনায় ওঠে এসেছে মানুষের ভেতরের প্রতিহিংসাপরায়নতা,ক্রুদ্ধতা ও যৌনতা।
- ১৫)এ ধারার লেখকের রচনায় বিশেষভাবে অনুপস্থিত অধ্যাত্মভাবনা,পারলৌকিক জীবন ও অতীন্দ্রিয়চেতনা।
- ১৬) তারা মনে করেন,শিল্পসাহিত্য আনন্দময় কোন ভ্রমণ নয়।
পরিশেষে বলা যায় যে,রিয়েলিজম বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের আলোকে গড়ে উঠেছে।
কোন মন্তব্য নেই