ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতি বলতে কি বুঝ? ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা করো

 ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতি বলতে কি বুঝ? ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য সমূহ আলোচনা করো

বাংলা সাহিত্যে ঐতিহাসিক সমালোচনা
বাংলা সাহিত্য



উপস্থাপনাঃ
আমাদের দেশে 'সমালোচনা' শব্দটিকে আমরা সাধারণত নিন্দার্থেই বেশি ব্যবহার করি যা যথার্থ নয়।' সমালোচনা' শব্দটি ভাঙলে আমরা 'সম' ও 'আলোচনা' এই দুটি শব্দ পাই। সম+ আলোচনা=সমালোচনা। শাব্দিক বিশ্লেষণ  করলে বুঝা যায়, সমালোচনায় সমানভাবে ভালো ও মন্দ দুটি দিকই আলোচনায় থাকবে।
শিল্প-সাহিত্যে সমালোচনা হচ্ছে কোন শিল্পকর্মের উৎকর্ষ অপকর্ষের বিচারমূলক সম্যক আলোচনা।সম্যক আলোচনা বলতে পন্ডিতগণ মনে করেন,যে শিল্পকর্মের সমালোচনা করা হবে তার ভাব, বিষয়বস্তু,গঠনরীতি,বিবিধ অলঙ্কার ব্যবহার এবং লেখকের মানসদৃষ্টি ইত্যাদির বিশ্লেষণ থাকবে।আধুনিক কালে সাহিত্য সমালোচনা বলতে সাহিত্যের গবেষণা, আলোচনা,মূল্যায়ন ও ব্যাখ্যা ইত্যাদির সম্মিলন বোঝায়।সমালোচনা পদ্ধতির সংখ্যা অনেক।এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতি।আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতি কাকে বলে এবং এর বৈশিষ্ট্য। নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ


কীভাবে, কার হাত ধরে এই পদ্ধতি গড়ে ওঠে?

উনিশ শতকের মধ্যভাগে ফরাসি সমালোচক হিপোলাইত তেইন ফরাসি ভাষায় ইংরেজি সাহিত্যের যে ইতিহাস 'History of English Literature' (১৮৫৬-৫৯) লিখেন,সেখানে প্রথম এই পদ্ধতিটির স্বরূপ প্রকাশিত হয় বলে পন্ডিতগণ মনে করেন।তবে তেইন এর আগে ভিকোর রচনায় এই পদ্ধতির সূত্রপাত লক্ষ্য করা যায়।আঠারো শতকেরই আরেকজন সমালোচক হার্ডার তাঁর 'Ideas on the philosophy of history' গ্রন্থে মন্তব্য করেন,সাহিত্যের ভাষারীতি ও রূপ যেমন মানুষের মেজাজের ওপর নির্ভর করে,তেমনি দেশের আবহাওয়া,পরিবেশ পরিস্থিতিও সাহিত্যের রূপ ও কাঠামোকে বদলে দেয়।তেইন এর হাতে এসে এই ধারণাগুলো বৈজ্ঞানিক পন্থায় একটি সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে।এই ধারার প্রধান লক্ষণ হলোঃ
  1. ১)বিষয়প্রাধান্য এবং বিষয় বিশ্লেষণে লেখকের সন্ধান।
  2. ২)লেখককে বিচার করতে গিয়ে তাঁর জন্মকাল,রচনাকাল বা তার সমসাময়িক কালে দেশের সার্বিক পরিস্থিতিকে বিবেচনায় আনা।

তেইন পরবর্তী সময়ে আরও অনেকেই এই পদ্ধতি সারাবিশ্বেই ব্যবহার করেছেন এবং সঙ্গতকারনেই কিছুটা পরিবর্তন ও আনেন।লিওলেন ট্রিলিং এর অবদান ও উল্লেখযোগ্য। বলা হয়ে থাকে,ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতি ট্রিলিং এর হাতে পূর্ণতা পায়।

ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতি বলতে কী বুঝায়?

ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতি হচ্ছে,কোন সাহিত্যকর্মের রচনাকালের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সাহিত্যকর্মটির বিশ্লেষণ বা মূল্যায়ন।তবে ইতিহাস বলতে এখানে বোঝায় সে সময়ের সামাজিক,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা।এই পদ্ধতিটি কোন সাহিত্যকর্ম কে ইতিহাসের পটভূমিতে রেখে সাহিত্যের ভেতর দিয়ে প্রতিফলিত সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসটি অন্বেষণ করে।এ সমালোচনা পদ্ধতি ইতিহাস কে ব্যবহার করে সাহিত্যকর্মটি কে ভালো করে বোঝাতে চেষ্টা করে।কারণ ইতিহাস কে তাঁরা গ্রহণ করে সজীব বস্তুরূপে,সচল প্রবাহরূপে-অবশ্যই অতীতের কোন মৃত বা পরিত্যক্ত স্মৃতিচিহ্ন রূপে নয়।তাঁরা মনে করেন,ইতিহাস আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে সাহিত্যবস্তুর অভ্যন্তরে।শিল্পসাহিত্য তাঁদের কাছে একটি ঐতিহাসিক শিল্প।তাই সাহিত্যবিচার ও সকল সময়েই একটি ঐতিহাসিক বীক্ষা বা বিশ্লেষণ।

ঐতিহাসিক সমালোচক প্রধানত দুটি দিকে মনযোগ দেন।
  1. এক. রচনাকালীন সময়ের সামাজিক,রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অবস্থা কীভাবে লেখাকে প্রভাবিত করেছে।
  2. দুই.এই পটভূমি বদলে যাওয়ার পরে সাহিত্যকর্মটির মূল্য বদলে যায় কী না।

ঐতিহাসিক সমালোচনা যে সময়ে গল্প,কবিতা তথা সাহিত্যকর্মটি রচিত হয়েছে সে সময় এবং সাহিত্যকর্মে বিধৃত সময়-দুটো সময়কেই বিশ্লেষণ করতে চায়।আবার যে সময়ে পাঠক লেখাটি পড়ে, সেই সময়টাও সমালোচকের একটি আগ্রহের বিষয়। সাহিত্যের বিষয় এবং সাহিত্যে ব্যবহৃত নির্দিষ্ট বা বিশেষ শব্দ, উপমা,রূপক, প্রতীক, চিত্রকল্প, চরিত্র, পরিণতি ইত্যাদির অর্থ,প্রয়োগ ও বিশ্লেষণ তাদের গবেষণার বিষয়।সাহিত্যকর্মে উপস্থাপিত চরিত্র বোঝার জন্য চরিত্রের স্থান, কাল ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বোঝা জরুরি বলে মনে করে। আমরা অনেক সময় লেখক এর উদ্দেশ্য বুঝতে পারি না, যদি না যে সময়ে লেখা হয়েছে, সে সময়টির রীতিনীতি বা সামাজিক সাংস্কৃতিক রীতিনীতি না বুঝি।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পথের পাঁচালী'র ইন্দির ঠাকুরন এর দাম্পত্য জীবনকে কিছুতেই বুঝা যাবে না, যদি না জানি সেসময়ের হিন্দু সমাজের রীতি-নীতি। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি উপন্যাসে একজন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কিভাবে তিন যুবতী বোনকে একত্রে বিয়ে করে তা বোঝা যাবে না, যদি ঐ সময়ে হিন্দুসমাজের ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাবটি না জানি। ব্রাহ্মণ্যবাদ না জানলে হৈমন্তী গল্পের হৈমন্তীর অকাল মৃত্যুর কারণ বুঝা যাবেনা।সেসময়কার সমাজ জীবন না বুঝলে একান্নবর্তী পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের অবস্থান বোঝা যাবে না।

হৈমন্তীর জীবনের সংকট আসে তার স্বামীর দূর সম্পর্কিত এক বৃদ্ধ আত্মীয়ার প্রশ্ন কে ঘিরেঃ বৌমার বয়স কত।

জেন অস্টিন ইংরেজি সাহিত্যের একজন লেখিকা। 1795 সালের পটভূমিতে রচিত একটি উপন্যাসের ধনী পিতার কন্যা সন্তানের দুরবস্থার কথা চিত্রিত হয়েছে। ধনী পিতার সন্তান হয়েও কন্যা নিঃস্ব কারন তখনও ইংল্যান্ডে পিতার মৃত্যুর পর কন্যা সন্তান পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতো না। এই আইনটি না জানলে কিছুতেই ঐ মেয়েটির সামাজিক বা মনোজাগতিক অবস্থাটি বিশ্লেষণ সম্ভব নয়।


ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যসমূহঃ
নিম্নে ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলোঃ

  1. ১)এজাতীয় আলোচনা পদ্ধতির উল্লেখযোগ্য বিষয় বৈশিষ্ট্য হলো- সাহিত্য বিশেষে উৎপত্তি-রহস্য বিশ্লেষণ।
  2. ২)সাহিত্য রচয়িতার হৃদয়ানুভূতির বিষয় হলেও এতে রচয়িতা অবশ্যই কোন না কোন অবস্থান ভূমির ওপর অবস্থান করেন।
  3. ৩)লেখক এর অবস্থানভূমির বিশেষণ এর উপর গড়ে ওঠা সমালোচনা পদ্ধতিই হচ্ছে- ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতি।
  4. ৪)ঐতিহাসিক সাহিত্য সমালোচনা কে যথার্থ এবং উন্নতর সাহিত্য বিচার বলে অভিহিত করা যায়।
  5. ৫)ঐতিহাসিক সমালোচনা পদ্ধতিতে সমালোচকের দৃষ্টি প্রধানত ইতিহাস ও পটভূমিকার উপর নিবদ্ধ থাকে।
  6. ৬)এই পদ্ধতিতে সাহিত্যবিচারের প্রাথমিক কর্তব্য তার সৃষ্টির ভিত্তিভূমি বিচার।
  7. ৭)ঐতিহাসিক সাহিত্য সমালোচনা পদ্ধতিতে ইতিহাস,সমাজ ও জীবনধারার প্রভাবে সাহিত্যের বিষয়,রূপ ও রীতির পরিবর্তন হয়।এই প্রভাবকে এক কথায় ইতিহাস বলে নির্দেশ করা যায়।
  8. ৮)এই পদ্ধতি অনুসন্ধান করে সাহিত্যকর্মটি লেখার সময় তার কী মূল্য ছিলো,লেখকের ঐতিহাসিক অবস্থানটি কেমন ছিলো।এখন একজন পাঠক কীভাবে ইতিহাসকে পুননির্মান করছে,তারও মূল্যায়ন করেন সমালোচক।
  9. ৯)এই পদ্ধতির সমালোচক প্রথমেই একটি প্রকল্প তথা হাইপোথিসিস গড়ে নেন।তারপর সাহিত্যকর্মটি বিশ্লেষণ করে গ্রহণ বর্জন,পরিবর্ত্ন পরিমার্জনের মাধ্যমে একটি রূপে দাঁড় করান।
  10. ১০)সাহিত্যকর্মের ভাষার সঙ্গে বর্তমানের ভাষার কী পরিবর্তন এসেছে তা বিশ্লেষণ করেন সমালোচক

সুতরাং সার্বিক আলোচনার মাধ্যমে বলা যায় যে,এ পদ্ধতি সাহিত্য সমালোচনায় সাহিত্যের উপর রচয়িতার কালিক প্রভাব যেহেতু বর্তমান-তাই এই পদ্ধতির সাহায্য লেখকের সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পরিমন্ডলের একটি নিঁখুত চিত্র পাওয়া যায় এবং সাথে সাথে উঠে সে সময়ের ভাষা ব্যবহারের বৈশিষ্ট্যসমূহ।

কোন মন্তব্য নেই

enot-poloskun থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.