কবি শামসুর রহমানের 'বন্দি শিবির থেকে' কাব্যের শিল্পমূল্য বিচার কর
কবি শামসুর রহমানের বন্দি শিবির থেকে কাব্যের শিল্পমূল্য বিচার কর
সূচনা
শামসুর রহমান (১৯২৯-২০০৬) বাংলাদেশের কবিগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠস্থান লাভের অধিকারী ছিলেন। অতিআধুনিক কাব্যধারার বৈশিষ্ট্য তাঁর রচনায় অত্যন্ত সার্থকভাবে প্রকাশ পেয়েছে।তাঁর কাব্যে সমকালীন জীবনের আন্দোলন আশা-আকঙ্খা রূপায়িত হয়ে উঠেছে।তাঁর সংবেদনশীল কবিসত্তা,জীবনাসক্তি এবং অতি আধুনিক কবিতার নির্মাণ-কৌশল তাঁকে বাংলাদেশের প্রধানতম কবি হিসেবে মর্যাদা দিয়েছে।দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তাঁর কাব্যে নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব কবির সত্তরতম জন্মদিনে তাঁকে 'কবিশ্রেষ্ঠ' ঘোষণা করেছিল।
কবি শামসুর রহমানের কাব্যে আধুনিকতার যথার্থ প্রকাশ ঘটেছে এবং কাব্যের সাম্প্রতিকতম বিবর্তনের সঙ্গেও তিনি সংযোগ সাধণ করেছিলেন।তাঁর মূল্যবোধ ছিল প্রধানত ব্যক্তিকেন্দ্রিক।কিন্তু এর সঙ্গে অন্তরঙ্গসূত্রে জড়িত হয়েছিল পারিপার্শ্ব,সমাজ ও সময়সজ্ঞানতা।উপমা ও চিত্রকল্পে তিনি ছিলেন প্রকৃতিনির্ভর এবং বিষয় ও উপাদানে তিনি ছিলেন শহরকেন্দ্রিক।
বন্দি শিবির থেকে কাব্যের বিষয়-বিন্যাস
১৯৭১ সালের মে মাস।ঢাকা শহর তখন পাকিস্তানি শকুন বেষ্টিত।ঢাকায় তখন শামসুর রহমান সন্ত্রাসবন্দি।ঢাকা শহর তখন কাফকার জগৎ।উৎপীড়ন,হত্যা এবং সন্ত্রাস কবির চারপাশে ভয়ংকর তমসাচ্ছন্ন ও বিভীষিকাময় পটভূমি।নীরন্ধ্র,শ্বাসরোধকারী সেলের ভেতর বন্দি জীবন।প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রতীক্ষা।ফৌজী জীপের গর্জন,ট্রাকের ঘর্ঘর,বুটের শব্দ,আগুন আর্তনাদ।স্নত্রাসের কাঁটাতারে বিদ্ধ কবি,জঙ্গি জীপের শব্দময় শহরের রূদ্ধবাক বাসিন্দা-এরই মধ্যে আশান্বিত শ্বাসজীবী কবি কিছু পংঙ্কতি তাঁর ডাইরিতে গচ্ছিত রাখলেন যার নাম-'বন্দি শিবির থেকে'।
কবি শামসুর রহমানের একটি বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ 'বন্দি শিবির থেকে' (১৯৭২)।এ কাব্যের অধিকাংশ কবিতা তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে বসে রচনা করেছেন।এ কাব্যের কবিতায় উঠে এলো- বাংলার বুকে পাকিস্তানি হানাদারদের নয় মাসের অবর্ণনীয় পাশবিকতা।পাকিস্তানি জল্লাদবাহিনী মানবতার কন্ঠকে স্তব্ধ করে মেতে উঠেছিল গণহত্যায়।লক্ষ লক্ষ বাঙালি শহিদ হয়েছেন তাদের পাশবিক হত্যাযজ্ঞে।ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর,শহর থেকে গ্রামে গঞ্জে-সমগ্র বাংলাদেশের জমিন তারা বাঙালির রক্তে রঞ্জিত করলো।
ট্রাকে করে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায় এদেশের নিরীহ যুবককে-বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে।মায়ের বুক থেকে কেড়ে নেয় যুবক ছেলেকে-সে আর ফিরে আসেনা।বাবার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় যুবতি কন্যাকে-তাকে ধর্ষন শেষে হত্যা করে ভাগাড়ে ফেলে দেয়।সমগ্র দেশটা তাদের দখলে-বাঙালিরা যেন এদেশে পরবাসী-কথা বলার অধিকার নেই।
তিনি আরো জানিয়েছেন-পঁচিশে মার্চ রাতের হত্যাযজ্ঞের পর তিনি নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে গ্রামে ছুটে গিয়েছিলেন এবং মে মাসের মধ্যসীমায় দেড় মাস পরে তিনি ঢাকায় ফিরেছিলেন।কবি লিখেছেনঃ
তখন আমি অনেকের মতো ,আমার এই প্রিয় শহর ঢাকায় সন্ত্রাসবন্দী।দেড় মাস পর ফিরে এসে দেখি,ঢাকা শহরের পথ-ঘাট প্রায় ফাঁকা,রাস্তায় খুব কম লোকজন দেখা যায়,চেনা মুখের সন্ধান পাওয়া ভার।তখন ঢাকা শহর এক বিভীষিকাময় পটভূমি।আমরা প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করতাম।
বুঝা যায় কবি প্রতিনিয়ত মৃত্যুকে সাথে করে যুদ্ধকালীন পরিবেশে বাস করেছেন ঢাকা শহরে। এখানে উল্লেখ্য যে এ সময় কবিরা ইচ্ছেমতো কবিতা লিখতে পারতেন বা কবিতা রচনা করলেও অনেক শব্দের উপর ছিল বিধিনিষেধ।কিন্তু একটি ঘটনা থেকে কবি কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা লাভ করেন এবং 'বন্দী শিবির থেকে' কাব্য রচনায় অভিনিবেশ করেন।কবি জানাচ্ছেনঃ
উনিশশো একাত্তরের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে একটি ছবি দেখেছিলাম সংবাদপত্রে-রাস্তার ধারে একজন গুলিবিদ্ধ মানুষ নিজের রক্ত দিয়ে লিখছেন শ্লোগান,তাঁর দেশের সপক্ষে,দেশবাসীর সপক্ষে।এই ছবি উজ্জ্বল হয়ে ফিরে এলো আমার কাছে,ফিরে এলো বারবার।ভাবতাম,যদি একজন মৃত্যু পথযাত্রী নিজের বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতির জাগরণের জ্বলন্ত স্বাক্ষর আঁকতে পারেন ,বোবা দেয়ালের গায়ে,যদি একটি পাথুরে দেয়ালকে করতে পারেন অমন ঐতিহাসিক,তবে আমি কেন খাতার পাতার পাতা শব্দাকীর্ণ করতে পারবো না।
আর এভাবেই কবির খাতার পাতা ভরে ওঠে যুদ্ধকালীন ঢাকা শহরের বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে।মূলত এ কাব্যে শামসুর রহমানের কবি মানসের পরিচয় পাওয়া যায় এবং একই সাথে অবরুদ্ধ ঢাকা শহরের ধ্বংসাত্মক পরিচয় ও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।'স্বাধীনতা' এই শব্দটি অর্জনের জন্য যুদ্ধকালীন সময়ে বাঙালি যে অত্যাচারের শিকার হয়েছে,কবির শব্দগুচ্ছে সেই ভয়াল দিনের চিত্র ফুটে উঠেছে 'তোমাকে পাওয়য়ার জন্যে,হে স্বাধীনতা' কবিয়ায়ঃ
তুমি আসবে বলে,হে স্বাধীনতা
শহরের বুকে জলপায় রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মতো চিৎকার করতে করতে।
তুমি আসবে বলে,হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস,বস্তি উজাড় হলো।রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালে যত্রতত্র।
স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ ও আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে 'তোমাকে পাওয়ার জন্যে ,হে স্বাধীনতা' কবিতায়।এই কবিতায় একই সঙ্গে দেখিয়েছেন স্বাধীনতাপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় কীভাবে বাঙালি প্রহর গুণে এবং স্বাধীনতা যে আসবেই এই পের্যাশা দৃঢ়মূল ধরেই আত্মত্যাগের চালচিত্র।কবির ভাষায় বলা যায়ঃ
স্বাধীনতা তোমার জন্যে
রাইফেল কাঁধে বনে-জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে-
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে,হে স্বাধীনতা।
'বন্দী শিবির থেকে' কাব্যের অন্তর্গত 'বন্দী শিবির' কবিতায় কবি যুদ্ধের সময় ঢাকা শহরের এবং শহরের মানুষের অবরুদ্ধতার চিত্র তুলে ধরেছেন এবং একই সাথে উঠে এসেছে পাকবাহিনীর ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া-কলাপ।কবি এখন সেই সব কবিদের কথা ভেবে ঈর্ষান্বিত যাঁরা এক সময় স্বাধীনভাবে শব্দ চয়ন করতে পারতেন এবং লিখতে পারতেন।কিন্তু কবির কাছে এখন তা অবরুদ্ধতার শামিল।কারন পাক সরকার কর্তৃক অকেক কিছুই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে।কবি বলেছেনঃ
অথচ এ দেশে আমি আজ দমবন্ধ
এ বন্দী শিবিরে
মাথা খুঁড়ে মরলেও পারিনা করতে উচ্চারণ
মনের মতন শব্দ কোন ও।
মনের মত্ন সব কবিতা লেখার
অধিকার ওরা
করেছে হরণ।
'তুমি বলেছিলে' কবিতায় উরুদ্ধ ঢাকা শরের বিশেষ করে নয়াবাজারের ধ্বংসযজ্ঞকে কবিতায় স্থান দিয়েছেন।কবিতার প্রথমেই তিনি নয়াবাজার ধ্বংস হওয়ার চিত্র এঁকেছেন-নয়াবাজারে পুড়ে যাচ্ছে দোকানপাট,কাঠ,লোহালক্কড়ের স্তূপ,মসজিদ,মন্দির,বিষম পুড়ছে চারপাশে-টিয়ের খাঁচা,রবীন্দ্ররচনাবলি,মিষ্টান্ন ভাণ্ডার,মানচিত্র,পুরানো দলিল।আর এই আগুনলাগা শহর থেকে সবাই জীবন নিয়ে পালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।কবিতার ভাষায়ঃ
পালাচ্ছে শহর ছেড়ে দিগ্বিদিক।নবজাতককে
বুকে নিয়ে উদ্ভ্রান্ত জননী
বনপোড়া হরিণীর মতো যাচ্ছে ছুটে।
'তার উক্তি' একটি ব্যতিক্রমধর্মী কবিতা।এই কবিতায় কবি রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে পাকসৈন্য কর্তৃক নিহত এক বুদ্ধিজীবীর কঙ্কালের জবানিতে বিষয়-ভাবনা প্রকাশ ঘটিয়েছেন।বুদ্ধিজীবী মানুষটিকে কীভাবে তার করুণ পরিণতি বরণ করে নিতে হয়েছে তার বর্ণনাও কবি দিয়েছেনঃ
আর এই শূন্য জায়গাটায়
স্পন্দিত হৃৎপিন্ড ছিল,যা ওরা নিয়েছে উপড়ে পাশব আক্রোশে
আর এই মাত্র যেটা লোভাতুর কুকুর মেয়াল
পালালো সাবাড় করে
এ জন্যেই জীবনের বৈমাত্রেয় দ্বিপ্রহরে হলাম কংকাল।
কাব্যের ভাষা
কবি এ কাব্যে কবিতা রচনার ক্ষেত্রে গদ্য ভাষার ব্যবহার করেছেন এবং গদ্যভাষায় পেয়েছে কাব্যিক পরিচর্যা। সমকালীন সময়-সমাজ থেকে উঠে এসেছে তাঁর ভাষা।তবে ভাষাকে কখনো জটিলভাবের মধ্যে নিয়ে গিয়েও আবার সহজতর করে তুলেছেন।যেমনঃ
কখনো অমিত্রাক্ষরে,ক্ষিপ্র মাত্রাবৃত্তে কখনো বা।
সে সব কবিতাবলি,যেন রাজহাঁস,
দৃপ্ত ভঙ্গিমায় মানুষের
অত্যন্ত নিকটে যায়,কুড়ায় আদর।
কবিতার ছন্দ
কবি 'বন্দী শিবির থেকে' কাব্যে অক্ষরবৃত্ত,মাত্রাবৃত্ত,স্বরবৃত্ত এবং গদ্যছন্দ চারটি ছন্দরীতিই ব্যবহার করেছেন।তবে এ কাব্যে অক্ষরবৃত্ত এবং গদ্যছন্দের বহুল ব্যবহার লখ করা যায়।যেমন তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর মধ্যে 'স্বাধীনতা তুমি' কবিতার ছন্দ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় কবি কীভাবে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার করেছেন।যেমনঃ
স্বাধীনতা তুমি/৬
বাগানের ঘর,কোকিলের গান,৮
স্বাধীনতা তুমি/৬
রবি ঠাকুরের অজর কবিতা/৮
অবিনাশী গান ৬
তবে নিঁখুত অক্ষরবৃত্ত ছন্দ বলতে যা বুঝায় কবি তা এ কাব্যে ব্যবহার করেননি।
কবিতার অলংকার
শামসুর রহমান 'বন্দী শিবির থেকে' উপমা,রূপক,চিত্রকল্প,অনুপ্রাস,উৎপ্রেক্ষা,প্রতীক বিভিন্ন ধরনের অলংকারের বহুল ব্যবহার করেছেন।তবে তাঁর অলংকার ব্যবহার সমকালীন প্রসঙ্গের উপরই বেশি নির্ভরশীল।যেমন-
উপমা
- ক)শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাংক এলো দানবের মতো চিৎকার করতে করতে।
- খ)নবজাতককে
- বুকে নিয়ে উদভ্রান্ত জননী
- বনপোড়া হরিণীর মতো যাচ্ছে ছুটে ।
চিত্রকল্প
তুমি আসবে বলে,হে স্বাধীনতা
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতা-মাতার লাশের উপর।
উৎপ্রেক্ষা
মৃত্যুর সাথে দাবা খেলি প্রায়-মৃত।
পরিশেষে বলা যায়,শামসুর রহমানের 'বন্দী শিবির থেকে' কাব্যে প্রকাশিত যুদ্ধের ভয়াবহতা,ঢাকা শহরের চালচিত্র এবং সমকালীন ঘটনা-প্রবাহ প্রকাশে এটি একটি বাস্তব দলিল।তাছাড়া কবির ভাব-ভাষা-ছন্দ-অলংকার ব্যবহারের গুণে কাব্যটি শিল্পসফলতা অর্জন করেছে।
কোন মন্তব্য নেই