'বন্দী শিবির থেকে' কাব্য অবলম্বনে শামসুর রহমানের স্বাধীনতা ও সমাজচেতনার পরিচয় দাও।

 বন্দী শিবির থেকে কাব্য অবলম্বনে শামসুর রহমানের স্বাধীনতা ও সমাজচেতনার পরিচয় দাও অথবা শামসুর রহমানের 'বন্দী শিবির থেকে' কাব্যের বিষয় ভাবনা আলোচনা কর 

বন্দী শিবির থেকে কাব্যের বিষয়ভাবনা
বাংলা সাহিত্য



মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের এক দীপান্বিত অধ্যায়,অস্তিত্বের সূতিকাগার,চেতনার জ্বলজ্বলে নক্ষত্র।নিজের অধিকারকে ছিনিয়ে আনার জন্য,দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ এক দীপালি সংযোজন।মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছি কথা বলার অধিকার।এ স্বাধীনতা,সার্বভৌমত্ব ও অধিকার আমরা একদিনে পাইনি।দীর্ঘদিনের আন্দোলন সংগ্রাম,রক্তদান এবং সর্বোপরি নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা ছিনিয়ে এনেছি স্বাধীনতার লাল সূর্য।আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন দেশ,একটি পতাকা।১৯৭১ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক পালাবদলের ক্রান্তিলগ্ন-অপরিমিত আশ্বাসের ফলশ্রুতিতে রক্তাক্ত সম্মুখ দ্বৈরথে বিপর্যস্ত ও ম্লানাহত হতে হতে বিশ্বাসের বাস্তব পটভূমিতে স্থিত।১৯৭১ এর ২৫ মার্চের সেই ভয়াল রাত্রি থেকে বাংলাদেশ যখন দাউ দাউ করে জ্বলছে,সমগ্র দেশ যখন দুঃস্বপ্নে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে,তখন মুক্তিযুদ্ধের সাথে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট সচেতন কবি শামসুর রহমান (১৯২৯-২০০৬) তাঁর 'বন্দি শিবির থেকে'(১৯৭২) কাব্যে বিভিন্ন কবিতায় চিত্রিত করেছেন পাকিস্তানের বর্বর সেনাদের জিঘাংসা চরিতার্থের ইতিকাহিনি।তাঁর এ কাব্যের ৩৮ টি কবিতার মধ্যে বেশকিছু কবিতা মুক্তিযুদ্ধকে প্রত্যক্ষভাবে ছুঁয়ে গিয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে যে কজন কবির কবিতা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে,মানুষের আবেগকে ছুঁতে পেরেছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম কবি হচ্ছে শামসুর রহমান।এমনিতেই তিরিশত্তোর বাংলা কাব্যসাহিত্যে এযাতকালে বাংলাভাষার সর্বাপেক্ষা প্রভাববিস্তারকারী  এবং গুরুত্বপূর্ণ কবি।মুক্তিযুদ্ধের সময় রচিত তাঁর কবিতাসমূহ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল বিন্দি শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থটি। শিরোনামের কবিতটিতেই অবরুদ্ধ কবির মুক্তির আকাঙ্ক্ষা,স্বাধীন দেশের স্বাঢীন কবিদের কাব্যরচনার,স্বাধীনতার প্রতি ঈর্ষার মধ্য দিয়ে প্রতিভাত।কবির প্রিয় শব্দ 'স্বাধীনতা' নিষিদ্ধ হয়ে গেছে বাঙলায়;কিন্তু তিনি চতুর্দিকে ,পাতায় ফুটপাতে পাখিতে নারীতে ঝলসে উঠতে দেখেন প্রিয় শব্দ 'স্বাধীনতা' কে।সারাটি কবিতা নরম ও বিষণ্ন।অত্যাচারিত,নিপীড়িতের পক্ষে যেটা স্বাভাবিক-ক্ষোভ,ক্রোধ,ঘৃণা,বিক্ষোভ,কোলাহল,চিৎকার এসবে কন্টকিত থাকতে পারত কবিতাটি।কিন্তু কবি নিজেকে সংযত করেছেন শিল্পীর সুষমায়।তিনি এখানে উচ্চকিত করে তুলেছেন বেদনা-আকাঙ্ক্ষা-কামনা-যন্ত্রনা। ফলে তাঁর কাম্য স্বাধীনতার চেতনা যেন শিশির শেলাই হয়ে যায় সারা বাঙলায়।কবির বাক-স্বাধীনতারুদ্ধ পরাধীনতার যাঁতাকলে,কবির গভীর আফসোস-

বন্ধুরা তোমরা যারা কবি,
স্বাধীন দেশের কবি,তাদের সৌভাগ্যে
আমি বড় ঈর্ষান্বিত আজ।
যা এখন খুশি

মনের মতন শব্দ কী সহজে করো ব্যবহার  
অথচ এ দেশে আমি আজ দমবন্ধ
এ বন্দী শিবিরে
মাথা খুঁড়ে মরলেও পারিনা করতে উচ্চারণ
মনের মতন শব্দ কোন ও।
মনের মতন  কবিতা লেখার 
অধিকার ওরা
করেছে হরণ।


'বন্দী শিবির থেকে ' কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় এক স্বপ্নবিলাশী মধ্যবিত্তের আত্মস্বরূপ অভিব্যক্ত হয়েছে,যেখানে বহির্জীবনের রক্তপাত,যুদ্ধ,নিপীড়িত-নির্যাতন বাঁধ ভাঙা স্রোতের মতো কবির অন্তর্লোকে প্রবেশ করেছে।মূলত, এ কাব্যে শামসুর রহমানের কবি মানসের পরিচয় পাওয়া যায় এবং একই সাথে অবরুদ্ধ ঢাকা শহরের ধ্বংসাত্মক পরিচয় ও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।'স্বাধীনতা' এই শব্দটি অর্জনের জন্য যুদ্ধকালীন সময়ে বাঙালি যে অত্যাচারের শিকার হয়েছে,কবির শব্দগুচ্ছে সেই ভয়াল দিনের চিত্র ফুটে উঠেছে 'তোমাকে পাওয়য়ার জন্যে,হে স্বাধীনতা' কবিয়ায়ঃ

তুমি আসবে বলে,হে স্বাধীনতা
শহরের বুকে জলপায় রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মতো চিৎকার করতে করতে।
তুমি আসবে বলে,হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস,বস্তি উজাড় হলো।রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালে যত্রতত্র।


 স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ ও আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে 'তোমাকে পাওয়ার জন্যে ,হে স্বাধীনতা' কবিতায়।এই কবিতায় একই সঙ্গে দেখিয়েছেন স্বাধীনতাপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় কীভাবে বাঙালি প্রহর গুণে এবং স্বাধীনতা যে আসবেই এই প্রত্যাশা দৃঢ়মূল ধরেই আত্মত্যাগের চালচিত্র। স্বাধীনতাকে পাবার জন্য এদেশের সাধারণ মানুষ থেকে ধরে সর্বশ্রেণির মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।সকনা বিবির মতো অনেক বাঙালি রমণীর কপালে দুঃখ ভোগের ছায়া নেমে এসেছে।হরিদাসীর মতো কত রমণীর সিঁথির সিঁদুর মুছে গেছে।দানবের মতো শহরের বুকে নেমেছে ট্যাঙ্ক।উজাড় হয়েছে বস্তি,ছাত্রাবাস,শহর বন্দর,ছাই হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম,অনেক অবুঝ শিশু তাদের পিতামাতার লাশের উপর হামাগুড়ি দিয়েছে।কবির ভাষায় বলা যায়ঃ

স্বাধীনতা তোমার জন্যে 
রাইফেল কাঁধে বনে-জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে-
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে,হে স্বাধীনতা।  


'বন্দি শিবির থেকে' কাব্যের কবিতায় সমগ্র বাংলার উপর পাকিস্তানি হায়নাদের যে অত্যাচার ,অবিচার, জুলুম,হত্যা,ধর্ষণ তা বিশ্বস্ত বাস্তবতায় অঙ্কিত হয়েছে।আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সামগ্রিক অত্যাচারের কাহিনিকে ধারণ করেছে এ কাব্যের বিভিন্ন কবিতা।  এ কাব্যের অধিকাংশ কবিতা তিনি মুক্তিযুদ্ধকালীন অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে বসে রচনা করেছেন।এ কাব্যের কবিতায় উঠে এলো- বাংলার বুকে পাকিস্তানি হানাদারদের নয় মাসের অবর্ণনীয় পাশবিকতা।পাকিস্তানি জল্লাদবাহিনী মানবতার কন্ঠকে স্তব্ধ করে মেতে উঠেছিল গণহত্যায়।লক্ষ লক্ষ বাঙালি শহিদ হয়েছেন তাদের পাশবিক হত্যাযজ্ঞে।ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর,শহর থেকে গ্রামে গঞ্জে-সমগ্র বাংলাদেশের জমিন তারা বাঙালির রক্তে রঞ্জিত করলো।

ট্রাকে করে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায় এদেশের নিরীহ যুবককে-বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে।মায়ের বুক থেকে কেড়ে নেয় যুবক ছেলেকে-সে আর ফিরে আসেনা।বাবার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় যুবতি কন্যাকে-তাকে ধর্ষন শেষে হত্যা করে ভাগাড়ে ফেলে দেয়।সমগ্র দেশটা তাদের দখলে-বাঙালিরা যেন এদেশে পরবাসী-কথা বলার অধিকার নেই।কবির ভাষায় বলা যায় যে,

আমরা তৃষিত হয়ে পড়েছিলাম এক ঝলক আলোর জন্যে।নীরান্ধ্র শ্বাসরোধকারী সেলের ভেতর বন্দী যেমন ব্যাকুল হয়ে থাকে একফোটা আলোর জন্যে,ঠিক তেমনি।


অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীকে শামসুর রহমান নরকবাস বলে অভিহিত করেছেন এবং কবিতার ছত্রে ছত্রে সেই নরকবাসের সময়টিকে বিম্বিত করেছেন বিভিন্ন চিত্রের মধ্য  দিয়ে অবশ্য সেই নরকবাস থেকে মুক্তির স্বপ্ন ও প্রবল বেগ পেয়েছিল এটি সত্য-

কখনো নিঝুম পথে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে কেউ গুলির আঘাতে,
মনে হয় ওরা গুলিবিদ্ধ করে স্বাধীনতাকেই।
দিনদুপুরে জিপে একজন তুলে কানামাছি করে
নিয়ে যায় ওরা;
মনে হয় চোখ-বাঁধা স্বাধীনতা যাচ্ছে বধ্যভূমিতে।
বেয়নেটবিদ্ধ লাশ বুড়িগঙ্গা কি শীতলক্ষ্যায় ভাসে;
মনে হয়,স্বাধীনতা লখিন্দর ,যেন,
বেহুলা বিহীন।


অবরুদ্ধ ঢাকা নগরী ছাড়াও সারা বাংলাদেশ তখন ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে থাকে ।বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে রয়েছে গ্রাম।তাই গ্রাম বাংলার সবুজ প্রকৃতি গোটা বাংলাদেশেরই অবয়ব নিয়ে মূর্ত যেন।এই বাংলার প্রকৃতি সুখের স্বপ্ন ছায়ায় আজন্ম লালিত।কিন্তু একাত্তরের পশ্চিমা নরঘাতকেরা সে সুখ স্বপ্নের বাগানে আগুন ধরিয়ে দেয়। 'আমাদের মৃত্যু আসে' কবিতায় কবি মৃত্যুর বিভীষিকাকে তুলে ধরেছেন।মৃত্যু যে পূর্ব বাংলার মানুষের জীবনে অস্বাভাবিকভাবে এসেছিল তা কবি লিপিবদ্ধ করেছেন।স্বাধীনতার সময় মৃত্যুর মিছিল চলে বাংলাদেশের সব জেলায়।এদেশের মৃত্যুর জন্য যে পাক সরকার এবং তাদের সৈন্যরা দায়ী ছিল তা কবি তুলে ধরেছেন।যেমন-

আমাদের মৃত্যু আসে প্লেনে চেপে জাহাজ বোঝাই করে আসে
আমাদের মৃত্যু আসে সুপরিকল্পিত নকশারূপে
আমাদের মৃত্যু আসে দূর ইসলামাবাদ থেকে
আমাদের মৃত্যু আসে কারবাইনে বারুদের স্তূপে
আমাদের মৃত্যু বিউগলে যায় ডেকে।


'তুমি বলেছিলে' কবিতায় অবরুদ্ধ ঢাকা শরের বিশেষ করে নয়াবাজারের ধ্বংসযজ্ঞকে কবিতায় স্থান দিয়েছেন।কবিতার প্রথমেই তিনি নয়াবাজার ধ্বংস হওয়ার চিত্র এঁকেছেন-নয়াবাজারে পুড়ে যাচ্ছে দোকানপাট,কাঠ,লোহালক্কড়ের স্তূপ,মসজিদ,মন্দির,বিষম পুড়ছে চারপাশে-টিয়ের খাঁচা,রবীন্দ্ররচনাবলি,মিষ্টান্ন ভাণ্ডার,মানচিত্র,পুরানো দলিল।আর এই আগুনলাগা শহর থেকে সবাই জীবন নিয়ে পালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।কবিতার ভাষায়ঃ

পালাচ্ছে শহর ছেড়ে দিগ্বিদিক।নবজাতককে
বুকে নিয়ে উদ্ভ্রান্ত জননী
বনপোড়া হরিণীর মতো যাচ্ছে ছুটে।


 'তার উক্তি' একটি ব্যতিক্রমধর্মী কবিতা।এই কবিতায় কবি রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে পাকসৈন্য কর্তৃক নিহত এক বুদ্ধিজীবীর কঙ্কালের জবানিতে বিষয়-ভাবনা প্রকাশ ঘটিয়েছেন।বুদ্ধিজীবী মানুষটিকে কীভাবে তার করুণ পরিণতি বরণ করে নিতে হয়েছে তার বর্ণনাও কবি দিয়েছেনঃ

আর এই শূন্য জায়গাটায়
স্পন্দিত হৃৎপিন্ড ছিল,যা ওরা নিয়েছে উপড়ে পাশব আক্রোশে
আর এই মাত্র যেটা লোভাতুর কুকুর মেয়াল
পালালো সাবাড় করে
এ জন্যেই জীবনের বৈমাত্রেয় দ্বিপ্রহরে হলাম কংকাল।


সুতরাং সার্বিক বিচারে বলা যায়,শামসুর রহমানের 'বন্দী শিবির থেকে' কাব্যে মূলত যুদ্ধকালীন বিভিন্ন পরিস্থিতির বর্ণনা লিপিবদ্ধ হয়েছে।এ কাব্যে ধ্বংস,হত্যা,নারকীয় অত্যাচার,পাকসৈন্য ও শাসকের ভূমিকা,এদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে গেরিলাদের ভূমিকা স্পষ্টভাবে প্রতীকায়িত।

কোন মন্তব্য নেই

enot-poloskun থেকে নেওয়া থিমের ছবিগুলি. Blogger দ্বারা পরিচালিত.